সাতসকালে খবরের কাগজে চোখ পড়তেই সারাটা দেহ হয়ে গেল হিমশীতল। মেয়ে কি না তার নিজের মা-বাবাকেই কুপিয়ে...! এর পরের কথাগুলো লিখতে গিয়ে আমার হাত কাঁপছে, কলম পড়ে গেল মেঝেতে। পাঠক, নিশ্চয়ই আঁচ করতে পারছেন কোন মেয়েটির কথা বলছি। মেয়েটি আপনার-আমার সমাজের সবারই। সে শুধু আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর পুলিশ অফিসার মাহফুজুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী স্বপ্না রহমানেরই মেয়ে নয়। এ মেয়ে চোখধাঁধানো অকল্পনীয় বিত্তবৈভবের পাশাপাশি সীমাহীন দারিদ্র্যমাখা সমকালীন বাংলাদেশের নবীন প্রজন্মের হটকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া বিপথগামী এক কিশোর-কিশোরীর প্রতীক। মা-বাবা যার নামটি বড় আদর করেই রেখেছিলেন 'ঐশী'। এ মেয়েটির বিরুদ্ধে প্রধান যে অভিযোগ তা হচ্ছে, সে তার মা-বাবাকে নিজের হাতে (জাতীয় দৈনিকগুলোর ভাষ্যমতে) খুন করেছে প্রাণঘাতী 'খঞ্জর' (ঐশীর ভাষায়) দিয়ে। যেহেতু এ ঘটনা মাননীয় বিচারালয়ের এখতিয়ারে, তাই আমরা মা-বাবা হিসেবে, সমাজের বাসিন্দা হিসেবে, শিক্ষক হিসেবে আমাদের ভূমিকাটুকুর কথাই বলব শুধু।
নাকি পরিবার, সমাজ নাকি অন্য কারোর? যে শিশুটি একদিন স্কুল ইউনিফর্ম পরে, কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে, টিফিন ও পানির বোতল নিয়ে, চুলে ছোট্ট দুটি বিনুনি বেঁধে, স্কুল শু পরে শৈশবে মায়ের হাতের আঙুল নিবিড়ভাবে চেপে ধরে গুটি গুটি পা ফেলে যে বিদ্যায়তনে (যেগুলোকে Temple of Learning বলে অভিহিত করা হয় গভীর শ্রদ্ধায়) যেত অসীম পুলকে, সেই স্কুলগুলোর শিক্ষকমণ্ডলীর কি কোনো দায়-দায়িত্ব নেই? না, আমরা যাঁরা শিক্ষক নামধারী, তাঁরা বুক চিতিয়ে নিজেদের নির্দোষ প্রমাণেই যত রকম ফন্দি-ফিকির আছে সেগুলোর গবেষণায় ওঠে পড়ে লাগব?
ঐশীর নামটি বড়ই প্রীতিকর, যার আভিধানিক অর্থ Divine বা Heavenly. যে মা তাঁর শ্রেষ্ঠতম ধনকে যক্ষের ধনের মতো বুকের মাঝে আগলে রাখতেন অষ্টপ্রহর, যে মা সব সময় ভাবতেন : I will be there when you need me. অনুমান করি যে ঐশীর জন্মদিনে মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন, শুভানুধ্যায়ী, বন্ধু-বান্ধবী সবাই একজোট হয়ে গ্রিক কোরাসের ভঙ্গিতে ১৮৯৩ সালে কেন্টাকির জনৈক টিচার এবং পিয়ানোবাদক মিলড্রেড হিল রচিত অসামান্য Birth Day Lyricsটি Happy Birth Day to you, Happy Birth Day to you, Happy Birth Day to you বলে ঐশীকে করে তুলত তুলনাহীনা এবং সেই নিবিড় আনন্দঘন পরিবেশে ঢাউস কেকটি কেটে পরিবেশকে করে দিত দারুণ এবং Sublime। হায়রে! সেই ঐশীই কি না...ভাবতে গেলে বুক ফেটে যায়। কেন এমন হয়? আমরা মা-বাবা হিসেবে, শিক্ষক হিসেবে, সামাজিক জীব হিসেবে, সর্বোপরি, 'মানুষ' নামধারী হয়ে 'পৃথিবী' নামক ছোট্ট এই গ্রহটির বাসিন্দা হিসেবে, মুখ দেখাই কী করে? কেন আমরা তাকে সময় দিতে পারলাম না, মা-বাবা হিসেবে? কেন আমাদের সমাজপতিরা রুক্ষ এ সমাজে সুন্দর ও নিরাপদ শিশুবান্ধব একটি মরূদ্যান প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ? কেন আমরা শিক্ষক হিসেবে অপারগ হলাম ঐশীর মধ্যে মানবিক মূল্যবোধের বীজ বপন করতে?
আধুনিক পরিবার মানেই তো ছোট পরিবার। প্রসন্নতায় ভরা আগের একান্নবর্তী পরিবারগুলো দ্রুত ভেঙে গেছে বা যাচ্ছে। সনাতন অ্যারেঞ্জড ম্যারেজের বদলে তরুণ-তরুণীরা ভালোবেসে নিজেদের পছন্দমতো বিয়েশাদী করছে এবং ছোট্ট পরিবার গড়ে তুলছে। কিন্তু এর কুফলই চোখে পড়ছে বড় বেশি, যা কিনা : You fall in love, you fall out-এর মতোই। Dual-income-couples-এর সমস্যাবলি বিবিধ। বিশ্বের তাবৎ অগ্রগামী দেশগুলোর মতো, একই তালে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের নারীরাও। এতে খারাপের কিছুই নেই, বরং ভালো ছাড়া। তবে শঙ্কার একটি বিষয় আছে বৈকি এবং তা হায়! কেন এমন হয়?
হচ্ছে, সময় দিতে না পারায় সন্তান যে বিপথগামী হচ্ছে তার কী হবে? বাংলাদেশের বিশিষ্ট জনৈক চিকিৎসকের মতে, যেসব ছেলেমেয়ে মা-বাবার পর্যাপ্ত আদর-যত্ন পায় না, তারা প্রায়ই কুসঙ্গে পড়ে মাদকাসক্ত হয় এবং এর জন্য তিনটি F-কে তিনি চিহ্নিত করেছেন : Friend, Fun ও Frustration। আসলে সন্তান 'রেইজিং' বা পালন খুবই কঠিন। টিনএজাররা খুবই আবেগপ্রবণ এবং তাদের সমস্যাবলি বেশির ভাগই মা-বাবার অজানা থাকে। এর ফলে তাদের Wonder age এবং মা-বাবার Real world-এর মাঝে সৃষ্টি হয় বিস্তর ব্যবধান এবং গড়ে ওঠে অদৃশ্য এক দেয়াল।
আমরা কি ভুলতে পারব এই সহস্রাব্দের সূচনায় আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়ান হাই স্কুলে ঘটে যাওয়া সেই ট্র্যাজেডির কথা, যেখানে Harris ও Klebold দুজন স্কুলছাত্র তাদের ১২ জন সহপাঠী ও একজন স্যারকে নিজেদের হাতে পাখির মতো গুলি করে মেরে ফেলেছিল এবং যে ঘটনা গোটা আমেরিকায় প্রচণ্ড আলোড়ন তুলেছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই একটি বিশেষ ডিপার্টমেন্টের জনৈক তরুণ প্রভাষকের নিত্যনতুন অনৈতিক কর্মকাণ্ডে (তৎকালীন পত্রিকার ভাষ্যমতে) অতিষ্ঠ হয়ে তাঁর বাবা একদিন বাধ্য হয়েই নিজ হাতে বন্দুক দিয়ে প্রাণপ্রিয় তরুণ ছেলেটিকে হত্যা করেন, সম্ভবত বনানীর কোনো এক অট্টালিকায়। ওই শিক্ষকের কার্যকলাপ (পত্রিকার ভাষায়) তাঁকে এত নিচে নামিয়ে ছিল যে মৃত্যুকালে পাশের কক্ষে অবস্থানরত নিজের বোনরাও নাকি (পত্রিকা অনুযায়ী) ভাইয়ের সেই অন্তিম দৃশ্যটি দেখতে যাননি। তবে সমাজ কতখানি অধঃপতিত হলে ঐশীর মা-বাবা হত্যা কিংবা বাবার দ্বারা স্বীয় সন্তান হত্যা সম্ভব, তা একমাত্র সমাজবিজ্ঞানী ও প্রাজ্ঞজনরাই ভালো বলতে পারবেন।
এবার আসুন, শিক্ষক সম্পর্কীয় বিষয়ে। এমনতর একটি কথা বহুল প্রচলিত এবং তা হচ্ছে : 'বাংলাদেশের শিক্ষককুল নিজেদের যথাযথ মূল্যায়িত বলে মনে করেন না।
শিক্ষকতায় ঢুকলে অনেক চিন্তাভাবনা করেই ঢোকা উচিত। যদি কাঁচা পয়সা পাওয়াই একজনের লক্ষ্য হয়ে থাকে, তবে তো কোনো রকমে এক রাতে এক কেজি হেরোইন জোগাড় করতে পারলেই তো হলো। সকালে তা বিশেষ স্থান ও নির্দিষ্ট পাত্রের কাছে পৌঁছে দিতে পারলেই কয়েক কোটি টাকা। তবে সেটাই তো ছিল ভালো। অথবা কিডনি জোগাড়ের খামার বানালেই তো একটি একটি শিশুর কিডনি বেচে লাখ লাখ টাকা আয়। সেটাই তো সহজ পথ ছিল। তাহলে আর শিক্ষকতার খাতায় নাম লেখানো কেন? টাকার প্রয়োজন সবারই আছে এবং তা এ দেশে যেমন, উন্নত বিশ্বেও তেমনি। আমি একটি দেশের কথা জানতাম, যেটা ছিল আমার মতো অনেকের কাছেই এক স্বর্গরাজ্য এবং আক্ষরিক অর্থেই এখনো তা-ই। ভাবতাম, সেখানের শিক্ষকরা নিশ্চয়ই সবাই টাকার বস্তার ওপর বসে থাকে। কিন্তু হায়! আমি অবাক বিস্ময়ে একদিন দেখলাম, ম্যানহাটনের প্রশস্ত রাজপথ দিয়ে ফেস্টুন বহনকারী শত শত স্নানমুখী শিক্ষক-শিক্ষিকা হেঁটে চলেছেন। সমাজকে উদ্দেশ্য করে লেখা ফেস্টুনের ভাষাটি ছিল :
IF WE ARE IMPORTANT TO YOUR FUTURE, THEN TAKE CARE OF OUR FUTURE.
ভাবলাম, কী আশ্চর্য! এখানেও সেই একই চিত্র। শিক্ষকদের চাহিদা তো অবশ্যই পূরণ করা উচিত; বিপরীতভাবে, শিক্ষকদেরও তাঁদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সজাগ থাকা উচিত। আমরা যতই জ্ঞান দান করি না কেন শিক্ষার্থীকে, মূল্যবোধের অবর্তমানে 'সকলি গরল ভেল' আর সত্যিকারের মিশন অর্জন? সে তো 'দিল্লি দূরাস্ত'-এর মতোই সুদূরপরাহত। আমরা ভুলে যাই, একজন সুশিক্ষকের সৎগুণ ছাত্রছাত্রীর অন্তরে স্বর্গীয় জ্যোতির মতোই বিকিরণ করে চলে আজীবন। শাশ্বত মূল্যবোধ যেমন- সহানুভূতি, সহমর্মিতা, স্নেহ-মমতা-ভালোবাসা, সহিষ্ণুতা, করুণার আলোড়ন, সংবেদনশীলতা, নারী জাতির প্রতি শ্রদ্ধা, ঔদার্য, ইনটিগ্রিটি, দয়া, ক্ষমা, নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ, দেশপ্রেম ও জাত্যাভিমান প্রভৃতি একজন হৃদয়বান শিক্ষক কোমলমতি বিদ্যার্থীদের হৃদয়ে গভীরভাবে প্রোথিত করে দেন তাঁর সহজাত কথাবার্তা, আচার-আচরণ, চালচলন, কার্যকলাপ ও উদাহরণের মাধ্যমে।
মা-বাবার যেমন দায়িত্ব আছে তাঁদের সন্তানদের প্রতি, শিক্ষকেরও তেমনি দায়িত্ব আছে ছাত্রছাত্রীর প্রতি।
হায়রে! এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। সমাজ আজ বিভ্রান্ত। মূল্যবোধের মড়ক। জনসংখ্যা বাড়ছে হু হু করে। লেখাপড়ার জন্য যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গজিয়ে উঠছে, সেখানে গুণগত শিক্ষার বড়ই অভাব। ছাত্রছাত্রীর মধ্যে প্রচণ্ড মূল্যবোধের অভাব। শিক্ষার প্রতি বেশির ভাগ শিক্ষকের অঙ্গীকার কম এবং এ জন্য তাদের কাছে Mission ও Profession-এর কোনো তফাত নেই; প্রভেদ নেই 'মার্সেনারি' আর 'মিশনারি'র মধ্যে। অথচ উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারীর মধ্যে যদি মূল্যবোধের অভাব থাকে, তবে একটি সময় আসবে, যখন অনিবার্যভাবেই তা তার কাছে 'বুমেরাং' হয়েই ফিরে আসবে। এবং আসবেই। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ককে গড়তে হবে স্নেহ-মায়া-মমতার বন্ধন দিয়ে। সম্পর্ক গড়ে তোলা যদিও কঠিন, এটা নষ্ট করা অতি সহজ। টাইটানিকের কথাই ধরুন না কেন : মানবমস্তিষ্কপ্রসূত কী বিশালই না ছিল এর পরিকল্পনা! বছরের পর বছর ধরে কী বিপুল অর্থ, প্রচণ্ড শ্রম, গভীর নিষ্ঠা আর মধুর স্বপ্নটাই না কাজ করল অদ্ভুত সুন্দর এই অর্ণবপোতটি সৃষ্টিতে। কিন্তু একটি অবিবেচক আর উদাসীন হিমশৈল মাত্র আধা ঘণ্টারও কম সময়ে সলিলসমাধি ঘটাল এই অবিস্মরণীয় কীর্তিটিকে। মোনালিসাকে দেখুন, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির কী অপূর্ব সৃষ্টি! কিন্তু যেকোনো একটি বড় মাপের গর্দভের জ্বলন্ত একটি সিগারেটের অসতর্ক আগুন এর সর্বনাশটি করে দিতে পারে এক মুহূর্তে। এগুলোই তো আমাদের সামনে অনেক বড় বড় উদাহরণ।
ঐশীর কথা নিয়ে শুরু করেছিলাম আমরা এবং এ লেখা যতই এগিয়েছে, রাত যতই গভীর হয়েছে, আমাদের দীর্ঘশ্বাস ততই গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে। বাংলাদেশের সচেতন মা-বাবা আজ বড়ই চিন্তিত ও বিষণ্ন। তাঁদের বিষাদ আমাদের বুকে বাজছে অতি করুণ হয়ে। তাই আমরা আবারও বুক বেঁধে দাঁড়াতে চাই। কেননা বিপুল মাশুল দিয়েই আমরা এ দেশটি পেয়েছি। আমাদের সামনে আশাবাদ ছাড়া আর তো কোনো পথ খোলা নেই।
নাকি পরিবার, সমাজ নাকি অন্য কারোর? যে শিশুটি একদিন স্কুল ইউনিফর্ম পরে, কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে, টিফিন ও পানির বোতল নিয়ে, চুলে ছোট্ট দুটি বিনুনি বেঁধে, স্কুল শু পরে শৈশবে মায়ের হাতের আঙুল নিবিড়ভাবে চেপে ধরে গুটি গুটি পা ফেলে যে বিদ্যায়তনে (যেগুলোকে Temple of Learning বলে অভিহিত করা হয় গভীর শ্রদ্ধায়) যেত অসীম পুলকে, সেই স্কুলগুলোর শিক্ষকমণ্ডলীর কি কোনো দায়-দায়িত্ব নেই? না, আমরা যাঁরা শিক্ষক নামধারী, তাঁরা বুক চিতিয়ে নিজেদের নির্দোষ প্রমাণেই যত রকম ফন্দি-ফিকির আছে সেগুলোর গবেষণায় ওঠে পড়ে লাগব?
ঐশীর নামটি বড়ই প্রীতিকর, যার আভিধানিক অর্থ Divine বা Heavenly. যে মা তাঁর শ্রেষ্ঠতম ধনকে যক্ষের ধনের মতো বুকের মাঝে আগলে রাখতেন অষ্টপ্রহর, যে মা সব সময় ভাবতেন : I will be there when you need me. অনুমান করি যে ঐশীর জন্মদিনে মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন, শুভানুধ্যায়ী, বন্ধু-বান্ধবী সবাই একজোট হয়ে গ্রিক কোরাসের ভঙ্গিতে ১৮৯৩ সালে কেন্টাকির জনৈক টিচার এবং পিয়ানোবাদক মিলড্রেড হিল রচিত অসামান্য Birth Day Lyricsটি Happy Birth Day to you, Happy Birth Day to you, Happy Birth Day to you বলে ঐশীকে করে তুলত তুলনাহীনা এবং সেই নিবিড় আনন্দঘন পরিবেশে ঢাউস কেকটি কেটে পরিবেশকে করে দিত দারুণ এবং Sublime। হায়রে! সেই ঐশীই কি না...ভাবতে গেলে বুক ফেটে যায়। কেন এমন হয়? আমরা মা-বাবা হিসেবে, শিক্ষক হিসেবে, সামাজিক জীব হিসেবে, সর্বোপরি, 'মানুষ' নামধারী হয়ে 'পৃথিবী' নামক ছোট্ট এই গ্রহটির বাসিন্দা হিসেবে, মুখ দেখাই কী করে? কেন আমরা তাকে সময় দিতে পারলাম না, মা-বাবা হিসেবে? কেন আমাদের সমাজপতিরা রুক্ষ এ সমাজে সুন্দর ও নিরাপদ শিশুবান্ধব একটি মরূদ্যান প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ? কেন আমরা শিক্ষক হিসেবে অপারগ হলাম ঐশীর মধ্যে মানবিক মূল্যবোধের বীজ বপন করতে?
আধুনিক পরিবার মানেই তো ছোট পরিবার। প্রসন্নতায় ভরা আগের একান্নবর্তী পরিবারগুলো দ্রুত ভেঙে গেছে বা যাচ্ছে। সনাতন অ্যারেঞ্জড ম্যারেজের বদলে তরুণ-তরুণীরা ভালোবেসে নিজেদের পছন্দমতো বিয়েশাদী করছে এবং ছোট্ট পরিবার গড়ে তুলছে। কিন্তু এর কুফলই চোখে পড়ছে বড় বেশি, যা কিনা : You fall in love, you fall out-এর মতোই। Dual-income-couples-এর সমস্যাবলি বিবিধ। বিশ্বের তাবৎ অগ্রগামী দেশগুলোর মতো, একই তালে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের নারীরাও। এতে খারাপের কিছুই নেই, বরং ভালো ছাড়া। তবে শঙ্কার একটি বিষয় আছে বৈকি এবং তা হায়! কেন এমন হয়?
হচ্ছে, সময় দিতে না পারায় সন্তান যে বিপথগামী হচ্ছে তার কী হবে? বাংলাদেশের বিশিষ্ট জনৈক চিকিৎসকের মতে, যেসব ছেলেমেয়ে মা-বাবার পর্যাপ্ত আদর-যত্ন পায় না, তারা প্রায়ই কুসঙ্গে পড়ে মাদকাসক্ত হয় এবং এর জন্য তিনটি F-কে তিনি চিহ্নিত করেছেন : Friend, Fun ও Frustration। আসলে সন্তান 'রেইজিং' বা পালন খুবই কঠিন। টিনএজাররা খুবই আবেগপ্রবণ এবং তাদের সমস্যাবলি বেশির ভাগই মা-বাবার অজানা থাকে। এর ফলে তাদের Wonder age এবং মা-বাবার Real world-এর মাঝে সৃষ্টি হয় বিস্তর ব্যবধান এবং গড়ে ওঠে অদৃশ্য এক দেয়াল।
আমরা কি ভুলতে পারব এই সহস্রাব্দের সূচনায় আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়ান হাই স্কুলে ঘটে যাওয়া সেই ট্র্যাজেডির কথা, যেখানে Harris ও Klebold দুজন স্কুলছাত্র তাদের ১২ জন সহপাঠী ও একজন স্যারকে নিজেদের হাতে পাখির মতো গুলি করে মেরে ফেলেছিল এবং যে ঘটনা গোটা আমেরিকায় প্রচণ্ড আলোড়ন তুলেছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই একটি বিশেষ ডিপার্টমেন্টের জনৈক তরুণ প্রভাষকের নিত্যনতুন অনৈতিক কর্মকাণ্ডে (তৎকালীন পত্রিকার ভাষ্যমতে) অতিষ্ঠ হয়ে তাঁর বাবা একদিন বাধ্য হয়েই নিজ হাতে বন্দুক দিয়ে প্রাণপ্রিয় তরুণ ছেলেটিকে হত্যা করেন, সম্ভবত বনানীর কোনো এক অট্টালিকায়। ওই শিক্ষকের কার্যকলাপ (পত্রিকার ভাষায়) তাঁকে এত নিচে নামিয়ে ছিল যে মৃত্যুকালে পাশের কক্ষে অবস্থানরত নিজের বোনরাও নাকি (পত্রিকা অনুযায়ী) ভাইয়ের সেই অন্তিম দৃশ্যটি দেখতে যাননি। তবে সমাজ কতখানি অধঃপতিত হলে ঐশীর মা-বাবা হত্যা কিংবা বাবার দ্বারা স্বীয় সন্তান হত্যা সম্ভব, তা একমাত্র সমাজবিজ্ঞানী ও প্রাজ্ঞজনরাই ভালো বলতে পারবেন।
এবার আসুন, শিক্ষক সম্পর্কীয় বিষয়ে। এমনতর একটি কথা বহুল প্রচলিত এবং তা হচ্ছে : 'বাংলাদেশের শিক্ষককুল নিজেদের যথাযথ মূল্যায়িত বলে মনে করেন না।
শিক্ষকতায় ঢুকলে অনেক চিন্তাভাবনা করেই ঢোকা উচিত। যদি কাঁচা পয়সা পাওয়াই একজনের লক্ষ্য হয়ে থাকে, তবে তো কোনো রকমে এক রাতে এক কেজি হেরোইন জোগাড় করতে পারলেই তো হলো। সকালে তা বিশেষ স্থান ও নির্দিষ্ট পাত্রের কাছে পৌঁছে দিতে পারলেই কয়েক কোটি টাকা। তবে সেটাই তো ছিল ভালো। অথবা কিডনি জোগাড়ের খামার বানালেই তো একটি একটি শিশুর কিডনি বেচে লাখ লাখ টাকা আয়। সেটাই তো সহজ পথ ছিল। তাহলে আর শিক্ষকতার খাতায় নাম লেখানো কেন? টাকার প্রয়োজন সবারই আছে এবং তা এ দেশে যেমন, উন্নত বিশ্বেও তেমনি। আমি একটি দেশের কথা জানতাম, যেটা ছিল আমার মতো অনেকের কাছেই এক স্বর্গরাজ্য এবং আক্ষরিক অর্থেই এখনো তা-ই। ভাবতাম, সেখানের শিক্ষকরা নিশ্চয়ই সবাই টাকার বস্তার ওপর বসে থাকে। কিন্তু হায়! আমি অবাক বিস্ময়ে একদিন দেখলাম, ম্যানহাটনের প্রশস্ত রাজপথ দিয়ে ফেস্টুন বহনকারী শত শত স্নানমুখী শিক্ষক-শিক্ষিকা হেঁটে চলেছেন। সমাজকে উদ্দেশ্য করে লেখা ফেস্টুনের ভাষাটি ছিল :
IF WE ARE IMPORTANT TO YOUR FUTURE, THEN TAKE CARE OF OUR FUTURE.
ভাবলাম, কী আশ্চর্য! এখানেও সেই একই চিত্র। শিক্ষকদের চাহিদা তো অবশ্যই পূরণ করা উচিত; বিপরীতভাবে, শিক্ষকদেরও তাঁদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সজাগ থাকা উচিত। আমরা যতই জ্ঞান দান করি না কেন শিক্ষার্থীকে, মূল্যবোধের অবর্তমানে 'সকলি গরল ভেল' আর সত্যিকারের মিশন অর্জন? সে তো 'দিল্লি দূরাস্ত'-এর মতোই সুদূরপরাহত। আমরা ভুলে যাই, একজন সুশিক্ষকের সৎগুণ ছাত্রছাত্রীর অন্তরে স্বর্গীয় জ্যোতির মতোই বিকিরণ করে চলে আজীবন। শাশ্বত মূল্যবোধ যেমন- সহানুভূতি, সহমর্মিতা, স্নেহ-মমতা-ভালোবাসা, সহিষ্ণুতা, করুণার আলোড়ন, সংবেদনশীলতা, নারী জাতির প্রতি শ্রদ্ধা, ঔদার্য, ইনটিগ্রিটি, দয়া, ক্ষমা, নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ, দেশপ্রেম ও জাত্যাভিমান প্রভৃতি একজন হৃদয়বান শিক্ষক কোমলমতি বিদ্যার্থীদের হৃদয়ে গভীরভাবে প্রোথিত করে দেন তাঁর সহজাত কথাবার্তা, আচার-আচরণ, চালচলন, কার্যকলাপ ও উদাহরণের মাধ্যমে।
মা-বাবার যেমন দায়িত্ব আছে তাঁদের সন্তানদের প্রতি, শিক্ষকেরও তেমনি দায়িত্ব আছে ছাত্রছাত্রীর প্রতি।
হায়রে! এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। সমাজ আজ বিভ্রান্ত। মূল্যবোধের মড়ক। জনসংখ্যা বাড়ছে হু হু করে। লেখাপড়ার জন্য যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গজিয়ে উঠছে, সেখানে গুণগত শিক্ষার বড়ই অভাব। ছাত্রছাত্রীর মধ্যে প্রচণ্ড মূল্যবোধের অভাব। শিক্ষার প্রতি বেশির ভাগ শিক্ষকের অঙ্গীকার কম এবং এ জন্য তাদের কাছে Mission ও Profession-এর কোনো তফাত নেই; প্রভেদ নেই 'মার্সেনারি' আর 'মিশনারি'র মধ্যে। অথচ উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারীর মধ্যে যদি মূল্যবোধের অভাব থাকে, তবে একটি সময় আসবে, যখন অনিবার্যভাবেই তা তার কাছে 'বুমেরাং' হয়েই ফিরে আসবে। এবং আসবেই। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ককে গড়তে হবে স্নেহ-মায়া-মমতার বন্ধন দিয়ে। সম্পর্ক গড়ে তোলা যদিও কঠিন, এটা নষ্ট করা অতি সহজ। টাইটানিকের কথাই ধরুন না কেন : মানবমস্তিষ্কপ্রসূত কী বিশালই না ছিল এর পরিকল্পনা! বছরের পর বছর ধরে কী বিপুল অর্থ, প্রচণ্ড শ্রম, গভীর নিষ্ঠা আর মধুর স্বপ্নটাই না কাজ করল অদ্ভুত সুন্দর এই অর্ণবপোতটি সৃষ্টিতে। কিন্তু একটি অবিবেচক আর উদাসীন হিমশৈল মাত্র আধা ঘণ্টারও কম সময়ে সলিলসমাধি ঘটাল এই অবিস্মরণীয় কীর্তিটিকে। মোনালিসাকে দেখুন, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির কী অপূর্ব সৃষ্টি! কিন্তু যেকোনো একটি বড় মাপের গর্দভের জ্বলন্ত একটি সিগারেটের অসতর্ক আগুন এর সর্বনাশটি করে দিতে পারে এক মুহূর্তে। এগুলোই তো আমাদের সামনে অনেক বড় বড় উদাহরণ।
ঐশীর কথা নিয়ে শুরু করেছিলাম আমরা এবং এ লেখা যতই এগিয়েছে, রাত যতই গভীর হয়েছে, আমাদের দীর্ঘশ্বাস ততই গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে। বাংলাদেশের সচেতন মা-বাবা আজ বড়ই চিন্তিত ও বিষণ্ন। তাঁদের বিষাদ আমাদের বুকে বাজছে অতি করুণ হয়ে। তাই আমরা আবারও বুক বেঁধে দাঁড়াতে চাই। কেননা বিপুল মাশুল দিয়েই আমরা এ দেশটি পেয়েছি। আমাদের সামনে আশাবাদ ছাড়া আর তো কোনো পথ খোলা নেই।
Comments
Post a Comment