মাদক জীবন কেড়ে নেয়
মাদক যে মানুষের তাজা প্রাণ কেড়ে নেয়, সংসারকে করে দেয় ল-ভ- এবং সকল সম্পর্কই চুঁকে যায় এ মাদকের ফলে এমন একটি ঘটনা উল্লেখ করার চেষ্টা করবো আজকের এই লেখায়। একদিন বায়তুল মোকাররম গেলাম একটি কাজে। দাঁড়িয়ে আছি উত্তর গেইটের পশ্চিম পার্শ্বে। এমন সময় অতি ক্ষীণকায় একজন মানুষ আমার পা জড়িয়ে ধরলো। তার আবদার দশটি টাকা। সে আজ কিছুই খায়নি। তার মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছিল না। খুব কাঁপছিল। আমি তার জন্য খাবার আনতে যাচ্চি শুনে সে আমার পা আরো শক্ত করে ধরলো। আমি তার জন্য খাবার আনতে যাব, এটি যেন তার বিশ্বাস হচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত আমার কাঁধের ব্যাগটি তার পাশে রেখেই আমি তার জন্য খাবার আনতে গিয়েছিলাম। ব্যাগ খোয়া যাওয়ার কোন ভয় আমার ছিল না। কারন, আমি বুঝতে পেরেছিলাম, তার ব্যাগ নয় খাবার প্রয়োজন। প্যাকেটের পুরু খাবার ও এক বোতল পানি খেল সে। আমি তার খুব কাছাকাছি বসলাম। তার এমন পরিণতি সম্পর্কে জানতে চাইলাম।। রফিক আমাকে বললো, তার বাবা-মা তাকে এইচএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করিয়েছে। আয়-রোজগারের জন্য ব্যবসাপাতিও ধরিয়ে দিয়েছে। ঢাকায় তার বাড়ি-গাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সবই ছিল। সর্বনাশা মাদক তার কাছ থেকে সব কেড়ে নিয়ে গেছে। এখন সে পথের ভিখারী। তার স্ত্রী সন্তান কোথায় আছে এটিও সে জানে না। চুখে তার জল নেই। সব জল গেছে শুকিয়ে।
রফিকের ব্যাপারে আমার উৎসাহ দেখে ফুটপাতের একজন ব্যবসায়ী এগিয়ে এলেন। রফিক সম্পর্কে আরো কিছু চমকপ্রদ তথ্য দিলেন তিনি। আমি ওই ভদ্র লোকের কাছে নয় রফিকের কাছেই রফিকের পরিণতি জানতে আগ্রহী ছিলাম। রফিক আমাকে জানায়, তার ব্যবসায়ী বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে এক সময় সে নেশার জগতে আসে। এক এক করে ছোট-বড় সব ধরনের নেশাই করে। এক সময় নেশার উপকরণ ব্যতীত তার জীবন অচল হয়ে পড়ে। এই নেশাই তাকে টেনে নিয়ে যায় অন্ধকার থেকে অন্ধকারে। এক সময় ব্যবসা বাণিজ্য, বাড়ি-গাড়ি সবই নেশার পেছনে চলে যায়। স্ত্রী-সন্তানরাও তাকে ছেড়ে চলে যায়। এখন সে পথের ফকির। যদিও নেশা করার টাকা তার কাছে নেই এখন। আর টাকা থাকলেও নেশা করতেন না বলে তিনি আমাকে জানান। যে নেশা তার জীবন থেকে সব কিছু কেড়ে নিয়ে গেছে সেই নেশাকে রফিক এখন চরমভাবে ঘৃণা করেন। এখন তিনি চিৎকার করে মানুষকে জানিয়ে দিতে চান যে, নেশা কাউকে ক্ষমা করে না। এই অভিশাপ থেকে কেউ মুক্তি পায় না। তার এই পরিণতিই প্রমাণ করে নেশা মানুষকে ধ্বংস করে দেয়। নেশা মানুষের জীবন কেড়ে নেয়। এসব কথা বলতে বলতে রফিক ডুুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকে। তার মুখ দিয়ে আর কোন কথা বের হয় না। আমিও চলে আসি আমার গন্তব্যে। এর কয়েক দিন পরে আমি যখন তাকে দেখতে যাই, ওই ফুটপাতের হকার আমাকে জানায়, রফিক বেশ ক’দিন আগে এখানেই মারা গেছে। তার মৃতুতে আমি বড়ই মর্মাহত হলাম। দু:খভরাক্রাস্ত হৃদয় নিয়ে চলে এলাম।
আমি জানি, মাদক নিয়ে লিখতে গেলেই প্রথমে আমার এলাকাকে নিয়ে লিখতে হবে। অন্যসব এলাকার মত আমার এলাকায়ও মাদকের ভয়াল ছোবল পড়েছে তরুণ প্রজন্ম ও উঠতি বয়সী ছাত্রছাত্রীদের মাঝে। মাদকের সহজলভ্যতা, প্রশাসনের অনৈতিকত যোগসাজশ এবং প্রভাবশালীদের সম্পৃক্ততার ফলে প্রায় সবধরনের মাদক সেবন ও বেচাকেনা চলছে দেদারছে দাউদকান্দি, ইলিয়টগঞ্জ বিশেষ করে কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী ব্যবসায়ীক প্রাণকেন্দ্র গৌরীপুর বাজারের বিভিন্ন স্পটে। এসব এলাকায় একরকম খোলা বাজারের মতই মাদক বেচাকেনা হয়। পুলিশ-প্রশাসনের সহযোগিতায় দীর্ঘদিন মাদক বাণিজ্য চলছে এখানে। দেখার কেউ নেই, বলারও কেউ েেনই। মাঝে মধ্যে সমাজসচেতন কেউ প্রতিবাদ করলে তার বারোটা বাজিয়ে ছাড়ে মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকাসক্তরা। আর এইসব লেখার কারণে আমাকেও হুমকি-ধমকি খেতে হয়েছে, হবে এবং অনেকের সঙ্গে আমার সম্পর্কও নষ্ট হয়েছে, হবে। এটা আমি জানি। কিš’ আমি যে তাদের ভালোবাসি, তাদেরকে এ সর্বনাশা পথ থেকে ফেরাতে চাই। যাদের আমি আপন মনে করি তারা আমাকে সবচেয়ে বেশী ভুল বুঝে। আমি কোনভাবেই তাদেরকে বোঝাতে সক্ষম হইনি যে, তাদেরকে মন থেকে ভালোবাসি বলেই আমার এতো মাথা ব্যথা মাদককে নিয়ে। আমি বহুবার চেয়েছি, মাদক মরণ নেশা খেকে তাদেরকে ফেরাতে। আমি বারবার ব্যর্থ হয়েছি। তবুও আশা ছাড়িনি-ছাড়বও না বলেই লিখে যাচ্ছি। আমি জানি, এই মাদক একজন সু¯’ ও সুন্দর-সজীব মানুষের জীবনকে সমুলে বিনাশ করে দেয়। আমি দেখেছি, এই মাদক ব্যক্তি-পরিবার সর্বোপরি সমাজে এক ভয়াবহ পরি¯ি’তি ও বিশৃংখলার সৃষ্টি করে। সন্তানের সঙ্গে বাবা-মার, মায়ের সঙ্গে ছেলের, ছেলের সঙ্গে বাবার, বোনের সঙ্গে ভাইয়ের, স্ত্রীর সঙ্গে স্বামীর এমনকি সব সম্পর্কই একসময় ছিনিয়ে নেয় এ অতি অশুভ শক্তিধর ভয়াবহ এই নীল বিষ-মাদক। অথচ, আমরা কোনভাবেই পারছি না আমাদের আপনজনদের এই পঙ্কিল পথ থেকে ফেরাতে। দিনে দিনে বেপরোয়া হয়ে ওঠছে তারা। অনেক সময় দেখা যাচ্ছে, মাদক নেশায় আসক্ত হয়ে খুন, রাহাজানি, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি ও পতিতাভিত্তির মত জঘন্য জঘন্য কর্মকা- করেই তারা ক্ষান্ত হচ্ছে না, তারা নিজের সন্তান এমনকি পিতা-মাতাকেও হত্যা করছে এই মাদকেরই কারণে। মাদকাসক্তরা একবারও ভাবছে না যে, মাদক নেওয়ার কারণে সর্বপ্রথম নিজেরাই ধ্বংস মুখে পতিত হচ্ছে। তাদের বিবেকে একবারও উদয় হচ্ছে না যে, এই জঘন্য ঘটনাগুলো কাদের ওপর ঘটানো হচ্ছে? আর যাদের ওপর ঘটানো হচ্ছে, তা কি শুধু ব্যক্তির ওপরই সীমাবদ্ধ থাকছে নাকি পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়েও এর কু-প্রভাব পড়ছে? আমার মনে হয়, আমাদের আপনজনদের (যারা মাদকাসক্ত) এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে আমরা যথাযথভাবে অবগত (মোটিভেশন) করতে পারছি না বলেই এর ভয়াভহতা দ্রুত প্রসার লাভ করছে।
আমরা লক্ষ্য করছি যে, গত কয়েক দিন যাবত মিডিয়ায় মাদকের ভয়াবহতা নিয়ে বেশ কয়েকটি খবর প্রকাশিত হয়েছে। মাদকের কারণে ঐশি তার বাবা-মাকে যে খুন করেছে এ সংবাদটি বিশ্ববাসী জেনেছে। এ লোমহর্ষক ঘটনাটি আমাদের সকলকে ভাবিয়ে তুলেছে। আমাদেরকে ফেলে দিয়েছে চরম লজ্জায়। এছাড়াও মাদকের রমরমা ব্যবসা, ভেজাল মাদক সেবনের ফলে শরীরে পচন ধরাসহ আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীদের সহযোগিতায় মাদক সেবন ও বিক্রির অভিযোগ এবং মাদক বিক্রেতাদের সঙ্গে সমাজের উচ্চশ্রেণীর মানুষদের সম্পৃক্ততার খবরও যে রয়েছে এসব প্রকাশিত সংবাদে। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, আজ সমাজের উঁচুস্তরের বিত্তবান থেকে আরাম্ভ করে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীসহ বেকার যুবক-যুবতী, শ্রমিক-রিক্শাচালক, ভিখারী, ব্যবসায়ী ও তথাকথিত উচ্চ শিক্ষিতসহ টোকাই ছোট্ট ছোট্ট ছেলে-মেয়েদের মাঝেও বিভিন্ন ধরনের ভয়াল মরণনেশা গ্রহণের প্রবণতা বেড়েই চলছে। কিš’ এর প্রতিকারে উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ আমরা গ্রহণ করতে পারছি না। যা আমাদের চরম ব্যর্থতার বহিঃপ্রকাশ বলে আজ প্রতিয়মান হচ্ছে। তবে কি আজ আমরা দেশের সামাজিক অবক্ষয়ের এই অব¯’ায় হাল ছেড়ে দেবো নাকি শক্ত করে হাল ধরবো, এ সিদ্ধান্ত এখনই আমাদেরকে নিতে হবে।
সম্প্রতি এক জরিপ দেখা গেছে, মাদকাসক্তদের শতকরা সত্তর থেকে পঁচাত্তর ভাগ ১১ থেকে ২৩ বছর বয়সী। যাদের বেশীর ভাগ বন্ধু-বান্ধবদের দ্বারা নেশায় আসক্ত হয়ে থাকে। আর নেশাগ্রস্ত হওয়ার পেছনে যেসব কারণ লুকায়িত থাকে, এর মধ্যে প্রিয়জনের আঘাত, অধিক কামনা-বাসনা, দীর্ঘ মেয়াদের বেকারত্ব, বাবা-মার স্নেহ বঞ্চিত, শখ তথা ফ্যাশন, মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়া এবং সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িত হওয়াকে সমভাবে দায়ী করা হয়েছে মাদক গ্রহনের কারণ হিসেবে। বর্তমানে মাদক গ্রহণকারীদের সবচেয়ে প্রিয় মাদকদ্রব্য হচ্ছে, ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাজা ও হেরোইন। শতকরা ৬৫ থেকে ৭০ ভাগ নেশাগ্রস্তরা তা এখন গ্রহণ করে। আর বাকিরা অন্যান্য নেশায় আসক্ত। বিশেজ্ঞদের মতে, দিনের পর দিন এসমস্ত নেশা গ্রহন করলে বিভিন্ন শারীরিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-স্মৃতিশক্তি লোভ, যৌন ক্ষমতা হ্রাস, রক্তে শ্বেতকণিকা হ্রাস, মানসিক ও শারীরিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়া, প্রতিদিন মাথাধরা, দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পাওয়া, ক্ষুধা মন্দা ও অবসাদগ্র¯’ হয়ে পড়াসহ আস্তে আস্তে জীবনীশক্তি ধ্বংস হয়ে যাওয়া।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, নেশা যে কোন ধরনের নেশাই হোক, তা আমাদের জীবনকে নিঃসন্দেহে ধ্বংস করে দেয়। এ নির্ঘাত ধ্বংস তথা মৃত্যু থেকে কোনোভাবেই বাঁচতে পারে না কেউ। বাঁচার একমাত্র পথ, এপথ থেকে দ্রুত সরে আসা। আমাদের তরুণ ও যুব সমাজসহ সকলস্তরের নেশাগ্রস্তদের এ মরণ ব্যাধির অভিশাপ থেকে বাঁচাতে দেশপ্রেমিক ও সর্বস্তরের বিবেকবান সচেতন মানুষসহ সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে এবং জোরালো আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে দেশের সর্বত্র। সরকারের অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণের পাশাপাশি সকল মাদকবিরোধী সংগঠন এবং অন্যান্য সামাজিক সংগঠনগুলোকেও সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে ব্যক্তি-পরিবার ও সামাজিকভাবে। আমাদের মনে রাখা বাঞ্ছনীয় যে, মানুষ জন্মের পরেই নেশাগ্রস্ত হয়না, নিশ্চয়ই কারো না কারো সংস্পর্শে সে মাদকাসক্ত হয়। যে কারণে অবহেলা-অনাদর, তুচ্ছ-তাচ্ছল্য নয়, মোটিভেশনই মুখ্য হাতিয়ার-তাদের ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে। এছাড়া অন্য পহ্না অবলম্বণে মাদকাসক্তদের আরো মাদকাসক্ত করে তুলে। বোঝানোর প্রক্রিয়াটি যদি হয় যথাযথ তাহলে অবশ্যই মাদকাসক্তদের ফেরানো যাবে-এই ভয়ংকর এবং অভিশাপের পথ থেকে। আবারও উল্লেখ করছি যে, এজন্য প্রথমে প্রয়োজন প্রত্যেক অভিভাবকদের সচেতনতা। এবং দেশের সামাজিক সংগঠনগুলোর উচিত, সাধ্য মত সভা-সেমিনার করে এর কুফল সম্পর্কে সকলকে যথাযথ ধারণা দেওয়া।
Comments
Post a Comment