প্রসূতি মহিলা শ্রমিক/চাকুরীজীবীর আইনানুগ সুযোগ-সুবিধা
প্রসূতি মহিলা শ্রমিক/চাকুরীজীবীর আইনানুগ সুযোগ-সুবিধা
সন্তান প্রসবের আগে এবং পরে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মহিলা শ্রমিকের চাকরি নিয়ন্ত্রণ এবং তাদের মাতৃ কল্যাণ সুবিধা দেয়া এবং মাতৃত্ব ছুটিতে থাকাকালীন সময়ে চাকরীচ্যুতি রোধ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ বিশদ আলোচনা করেছে। মূলত কতিপয় ক্ষেত্রে মহিলা শ্রমিকের কর্মে নিয়োগ নিষিদ্ধ, প্রসূতি কল্যাণ সুবিধা প্রাপ্তির অধিকার এবং প্রদানের দায়িত্ব, প্রসূতি কল্যাণ সুবিধা পরিশোধ সংক্রান্ত পদ্ধতি, সুবিধার পরিমাণ ইত্যাদিই এর আলোচ্য বিষয়। আমাদের দেশের বেশীর ভাগ শ্রমিকই তাদের সুযোগ সুবিধা সম্বন্ধে অজ্ঞ এবং মালিক পক্ষও এতে কোন পদক্ষেপ নেয় না, তাই তাদেরকে তাদের সুযোগ, সুবিধা সম্বন্ধে জানানো আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।
প্রথমত, কোন মালিক তার প্রতিষ্ঠানে সজ্ঞানে কোন মহিলাকে তার সন্তান প্রসবের অব্যবহিত পরবর্তী আট সপ্তাহের মধ্যে কোন কাজ করাতে পারিবেন না৷ পাশাপাশি কোন মহিলাও কোন প্রতিষ্ঠানে তার সন্তান প্রসবের অব্যবহিত পরবর্তী আট সপ্তাহের মধ্যে কোন কাজ করিতে পারিবেন না৷ কোন মালিক কোন মহিলাকে এমন কোন কাজ করার জন্য নিয়োগ করিতে পারিবেন না যা দুষ্কর বা শ্রম-সাধ্য অথবা যার জন্য দীর্ঘক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকিতে হয় অথবা যে কাজ তার জন্য হানিকর হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, যদি- মালিকের এই বিশ্বাস করার কারণ থাকে, অথবা যদি মহিলা তাকে অবহিত করে যে, দশ সপ্তাহের মধ্যে তার সন্তান প্রসব করার সম্ভাবনা আছে অথবা মালিকের জানামতে মহিলা পূর্ববর্তী দশ সপ্তাহের মধ্যে সন্তান প্রসব করেছেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে একজন প্রসূতি মহিলা শ্রমিক কত দিন এই ছুটি পাবেন। উত্তর, প্রত্যেক মহিলা শ্রমিক তার মালিকের নিকট হতে তার সন্তান প্রসবের সম্ভাব্য তারিখের অব্যবহিত পূর্ববর্তী আট সপ্তাহ এবং সন্তান প্রসবের অব্যবহিত পরবর্তী আট সপ্তাহের জন্য প্রসূতি কল্যাণ সুবিধা পাবার অধিকারী হবেন, এবং তার মালিক তাকে এই সুবিধা প্রদান করিতে বাধ্য থাকিবেন। অর্থাৎ, সন্তান প্রসবের পূর্বে এবং পরে আট সপ্তাহ করে মোট ষোল সপ্তাহ ছুটি পাবেন একজন মহিলা শ্রমিক এবং এই ছুটি দিতে মালিক আইনত বাধ্য। তবে এই ছুটি পাবার জন্য কিছু শর্ত রয়েছে তা হল, কোন মহিলা উক্তরূপ সুবিধা পাইবেন না যদি না তিনি তার মালিকের অধীন তার সন্তান প্রসবের অব্যবহিত পূর্বে অন্যুন ছয় মাস কাজ করিয়া থাকেন৷ অর্থাৎ, ন্যূনতম ছয় মাস ঐ মালিকের অধীন কাজ না করলে এই ছুটি তিনি পাবেন না। আবার, কোন মহিলাকে উক্তরূপ সুবিধা পাবেন না যদি তার সন্তান প্রসবের সময় তার দুই বা ততোধিক সন্তান জীবিত থাকে। মূলত জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ এবং মালিকদের খানিক সুবিধার জন্য কোন মহিলার দুই বা ততোধিক সন্তান জীবিত থাকলে তার তৃতীয় সন্তানের ক্ষেত্রে এই সুবিধা দিতে মালিক আইনত বাধ্য থাকবে না। তবে ঐ মহিলা অন্যান্য কোন ছুটি পাবার অধিকারী হলে তা পাবেন৷
কোন অন্তঃসত্ত্বা মহিলা এই আইনের অধীন প্রসূতি কল্যাণ সুবিধা পাবার অধিকারী হলে তিনি যে কোন দিন মালিককে লিখিত বা মৌখিকভাবে এই মর্মে নোটিশ দিবেন যে, নোটিশের আট সপ্তাহের মধ্যে তার সন্তান প্রসবের সম্ভাবনা আছে, এবং উক্ত নোটিশে তার মৃত্যুর ক্ষেত্রে এই সুবিধা যিনি গ্রহণ করিবেন তার নামও উল্লেখ থাকিবে৷ অর্থাৎ, নমিনির নামও উল্লেখ করতে হবে।
কোন মহিলা উক্তরূপ কোন নোটিশ প্রদান না করে থাকলে তার সন্তান প্রসবের সাত দিনের মধ্যে তিনি উক্তরূপ নোটিশ প্রদান করে তার সন্তান প্রসব সম্পর্কে মালিককে অবহিত করিবেন৷
কোন মালিক সংশ্লিষ্ট মহিলার ইচ্ছানুযায়ী নিম্নলিখিত ৩ উপায়ের যে কোন পন্থায় প্রসূতি কল্যাণ সুবিধা প্রদান করিবেন। যথাঃ-
১। যে ক্ষেত্রে কোন রেজিস্টার্ড চিকিত্সকের নিকট হইতে এই মর্মে প্রাপ্ত প্রত্যয়নপত্র পেশ করা হয় যে, মহিলা আট সপ্তাহের মধ্যে সন্তান প্রসবের সম্ভাবনা আছে, সে ক্ষেত্রে প্রত্যয়ন পত্র পেশ করার পরবর্তী তিন কর্ম দিবসের মধ্যে প্রসব পূর্ববর্তী আট সপ্তাহের জন্য প্রদেয় প্রসূতি কল্যাণ সুবিধা প্রদান করিবেন, এবং মহিলার সন্তান প্রসবের প্রমাণ পেশ করার তারিখ হইতে পরবর্তী তিন কর্ম দিবসের মধ্যে অবশিষ্ট সময়ের জন্য প্রদেয় উক্তরূপ সুবিধা প্রদান করিবেন; অথবা
২। মালিকের নিকট সন্তান প্রসবের প্রমাণ পেশ করার পরবর্তী তিন কর্ম দিবসের মধ্যে সন্তান প্রসবের তারিখসহ উহার পূর্ববর্তী আট সপ্তাহের জন্য প্রদেয় প্রসূতি কল্যাণ সুবিধা প্রদান করিবেন, এবং উক্ত প্রমাণ পেশের পরবর্তী আট সপ্তাহের মধ্যে অবশিষ্ট মেয়াদের সুবিধা প্রদান করিবেন; অথবা
৩। সন্তান প্রসবের প্রমাণ পেশ করার পরবর্তী তিন কর্ম দিবসের মধ্যে উক্ত সম্পূর্ণ সময়ের জন্য প্রদেয় প্রসূতি কল্যাণ সুবিধা প্রদান করিবেন।
উপরিউক্ত তিন উপায়ের কোন উপায়ে প্রসূতি মহিলা শ্রমিক তার মালিক থেকে প্রসূতি কল্যাণ বা উহার কোন অংশ পাবেন তা সন্তান প্রসবের প্রমাণ পেশের উপর নির্ভরশীল। সেরূপ কোন প্রমাণ কোন মহিলা তার সন্তান প্রসবের তিন মাসের মধ্যে পেশ না করিলে তিনি এই সুবিধা পাবার অধিকার হইবেন না৷ অতএব, তিন মাসের মধ্যে যে করেই হোক তা পেশ করতে হবে।
ভিন্ন ভিন্ন ক্যাটাগরিতে বিভিন্ন পরিমাণ হিসেবে এই আইনের অধীন প্রসূতি কল্যাণ সুবিধা প্রদান করা হবে। মূলত, শ্রমিকদের মধ্যে কিছু শ্রমিক দৈনিক, কিছু শ্রমিক সাপ্তাহিক, আবার অধিকাংশ শ্রমিক মাসিক মজুরি নিয়ে থাকে। তাই, দৈনিক, সাপ্তাহিক বা মাসিক গড় মজুরী গণনার জন্য সংশ্লিষ্ট মহিলা কর্তৃক নোটিশ প্রদানের অব্যবহিত পূর্ববর্তী তিন মাসে তার প্রাপ্ত মোট মজুরীকে উক্ত সময়ে তার মোট প্রকৃত কাজের দিনগুলি দ্বারা ভাগ করতে হবে৷ অর্থাৎ, তিনি যেদিন ছুটির জন্য নোটিশ দিবেন, তার পূর্ববর্তী তিন মাসে তার প্রাপ্ত মজুরিকে তার কর্ম দিবস দিয়ে ভাগ করে গড় মজুরী হারে সম্পূর্ণ নগদে প্রদান করতে হবে।
প্রসূতি কল্যাণ সুবিধা পাওয়ার অধিকারী কোন মহিলা সন্তান প্রসবকালে অথবা উহার পরবর্তী আট সপ্তাহের মধ্যে মৃত্যুবরণ করিলে মালিক ঐ শিশু সন্তানটি যদি বাঁচিয়া থাকে তখন যে ব্যক্তি শিশুর তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তাকে উক্তরূপ সুবিধা প্রদান করিবেন এবং, যদি শিশু সন্তান জীবিত না থাকে, তা হলে এই অধ্যায়ের অধীন মহিলার মনোনীত ব্যক্তি(নমিনি)কে অথবা কোন মনোনীত ব্যক্তি না থাকিলে মৃত মহিলার আইনগত প্রতিনিধকে উক্তরূপ সুবিধা প্রদান করিবেন৷ যদি উক্তরূপ কোন মহিলা প্রসূতি কল্যাণ সুবিধা পাওয়ার অধিকারী হওয়ার সময় সীমার মধ্যে কিন্তু সন্তান প্রসবের পূর্বে মারা যান, তা হলে মালিক উক্ত মহিলার মৃত্যুর তারিখসহ তত্পূর্ববর্তী সময়ের জন্য উক্তরূপ সুবিধা প্রদান করিতে বাধ্য থাকিবেন, তবে ইতিমধ্যে প্রদত্ত উক্তরূপ সুবিধা যদি প্রদেয় সুবিধা হইতে বেশী হয়, তা হলেও উহা আর ফেরত লইতে পারিবেন না, এবং মহিলার মৃত্যুর সময় পর্যন্ত যদি মালিকের নিকট এই বাবদ কিছু পাওনা থাকে, তা হলে তিনি এই অধ্যায়ের অধীন মহিলার কোন মনোনীত ব্যক্তিকে, অথবা কোন মনোনীত ব্যক্তি না থাকিলে, তার আইনগত প্রতিনিধকে উহা প্রদান করিবেন৷
যদি কোন মহিলার সন্তান প্রসবের পূর্ববতী ছয় মাস এবং সন্তান প্রসবের পরবর্তী আট সপ্তাহ মেয়াদের মধ্যে তাকে চাকুরী হইতে ডিসচার্জ, বরখাস্ত বা অপসারণ করার জন্য অথবা তার চাকুরী অন্যভাবে অবসানের জন্য মালিক কোন নোটিশ বা আদেশ প্রদান করেন এবং উক্তরূপ নোটিশ বা আদেশের যদি যথেষ্ট কোন কারণ না থাকে তা হলে, এই নোটিশ বা আদেশ প্রদান না করা হলে তাহলে ঐ মহিলা যে প্রসূতি কল্যাণ সুবিধা পাবার অধিকারী হতেন, তা হতে তিনি বঞ্চিত হইবেন না৷ যে যার অবস্থান থেকে আইন তথা নিজের দায়িত্বের পাশাপাশি সুযোগ-সুবিধাসমূহ জানা একান্ত জরুরী। নিজে আইন জানুন এবং অন্যকে জানান।
Comments
Post a Comment