পিতা-মাতার ভরণপোষন বাধ্যতামূলক করে আইন ও এর বিশ্লেষণ
পিতা-মাতার ভরণপোষন বাধ্যতামূলক করে আইন ও এর বিশ্লেষণ
জাতীয় সংসদে পিতামাতার ভরণপোষন বাধ্যতামূলক করে বৃহস্পতিবার একটি বিল পাস হয়েছে। সন্তানরা পিতামাতার ভরণপোষনের ব্যবস্থা না করলে এক লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে সর্বোচ্চ তিন মাসের জেলের বিধান করে এ বিল পাস করা হয়েছে। পিতামাতার অবর্তমানে দাদা-দাদীকে এবং মাতার অবর্তমানে নানা-নানীকে ভরণপোষণ করতে হবে বলে আইনে বলা হয়েছে। কোনো সন্তানের স্ত্রী বা স্বামী পিতামাতার ভরণপোষণ না করতে প্ররোচনা দিলে উক্ত স্ত্রী বা স্বামীও কিংবা অন্য সহায়তাকারী উপরোক্ত অপরাধে অভিযুক্ত হবেন।
বিল অনুযায়ী পিতামাতা আলাদাভাবে বসবাস করলে তাদের সন্তানের আয়ের ১০ শতাংশ নিয়মিতভাবে দিতে হবে। পিতা-মাতার একাধিক সন্তান থাকলে এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করে ভরনপোষণ করতে হবে। ‘পিতা-মাতার ভরণপোষণ বিল ২০১৩’ নামে এটি পাসের প্রস্তাব করেন জাতীয় পার্টির এমপি মুজিবুল হক চুন্নূ। পরে সেটি কণ্ঠভোটে পাস হয়। গত বুধবার সংসদের কার্য উপদেষ্টা কমিটির সভায় এ বিলটি পাসের সিদ্ধান্ত হয়। মন্ত্রী ছাড়া অন্য সদস্যরা আইন উত্থাপন করলে তা বেসরকারি বিল হিসেবে বিবেচিত হয়। সংসদে বেসরকারি বিল পাসের ঘটনা খুবই কম। এ নিয়ে নয়টি সংসদে মোট সাতটি বেসরকারি বিল পাস হয়েছে। এ নিয়ে বর্তমান সংসদে তিনটি বেসরকারি বিল পাস হলো। চলতি সংসদে সর্বশেষ ২০১১ সালে সাবের হোসেন চৌধুরীর ‘দ্যা লেপারস (রিপিল) অ্যাক্ট, ২০১১’ সংসদে পাস হয়।
পিতা-মাতার ভরপোষণ সংক্রান্ত আইনে উল্লিখিত অপরাধ জামিনযোগ্য ও আপসযোগ্য করা হয়েছে। বিলে বলা হয়েছে, প্রত্যেক সন্তানকে তার পিতা মাতার ভরণপোষণ নিশ্চিত করতে হবে। কোনো সন্তানের স্ত্রী বা স্বামী পিতামাতার ভরণপোষণ না করতে প্ররোচনা দিলে উক্ত স্ত্রী বা স্বামীও কিংবা অন্য সহায়তাকারী উপরোক্ত অপরাধে অভিযুক্ত হবেন।
বিল অনুযায়ী তাদের ভরণপোষণ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে প্রত্যেক সন্তানকে পিতা-মাতাকে একইসঙ্গে একই স্থানে বসবাস নিশ্চিত করতে হবে। কোনো সন্তান তার পিতা বা মাতাকে বা উভয়কে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বৃদ্ধনিবাস, বা অন্য কোথাও বা আলাদা আলাদভাবে বসবাস করতে বাধ্য করতে পারবেন না।
বিলে বলা হয়েছে প্রত্যেক সন্তান তার পিতামাতার স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজখবর রাখবে। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা ও পরিচর্যা করবে। তারা পৃথকভাবে বসবাস করলে সন্তানদের নিয়মিত সাক্ষাত করতে হবে। পিতামাতার অবর্তমানে দাদা-দাদীকে এবং মাতার অবর্তমানে নানা-নানীকে ভরণপোষণ করতে হবে।
এ আইন পাসের মধ্যে নিশ্চিত হলো জীবনের পড়ন্ত বেলায় কোনো প্রবীণকেই যেন ভুগতে না হয় একাকিত্বে, যেতে না হয় বৃদ্ধাশ্রমে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আর্থিক দৈন্য, একাকিত্বের কারণে বাংলাদেশের অনেক প্রবীণের জীবন কাটে কষ্ট-দুর্দশা ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্য দিয়ে। দরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত প্রবীণদের পাশাপাশি অবস্থাপন্ন অনেক প্রবীণের জীবনেও রয়েছে নানা সমস্যা। দরিদ্র প্রবীণদের আর্থিক দৈন্যের কারণে তাদের জীবন কাটে অন্যের দ্বারে ক্ষুধা, রোগ, জরার মধ্য দিয়ে। অন্যদিকে অবস্থাপন্ন প্রবীণদের কেউ কেউ নিঃসন্তান, সন্তানদের দূরে বসবাস এবং নিকটাত্মীয় না থাকায় একাকিত্ব ছাড়াও তারা সম্মুখীন হন নানা সমস্যায়। এজন্য ধনী, গরিব নয়, প্রত্যেক প্রবীণকেই দিতে হবে সুষম খাবার, স্বাস্থ্যসেবা এবং বিনোদনের ব্যবস্থা। সম্প্রতি বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অফ ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের এক তথ্যে জানা যায়, বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখের মতো প্রবীণ রয়েছে। তাদের মধ্যে শতকরা ৮৮ ভাগ প্রবীণেরই থাকতে হয় কোনো না কোনো সন্তান পরিবারের বাইরে। শতকরা ২০ জন হয় একাকী পরিবার কিংবা পরিজনহীন অথবা কেবল স্বামী-স্ত্রী মিলে বসবাস করেন। নানা দুরবস্থার মধ্য দিয়ে কাটে তাদের জীবন । অথচ দেশ, রাজনীতি, সমাজ, ধর্ম ও সভ্যতার প্রতিটি স্তরেই রয়েছে প্রবীণদের ভূমিকা। প্রবীণ শব্দে লুকিয়ে আছে শ্রদ্ধা, মমতা, ভালোবাসা, ত্যাগ, প্রেরণা, আস্থা ইত্যাদি। আজকে যারা প্রবীণ, কোনো না কোনো সময় তারা নবীন হয়ে দেশ ও জাতি রক্ষার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। প্রবীণ সমাজের এত যে অবদান, ত্যাগ, তার কি যথাযথ মর্যাদা আমরা দিতে পারি না? আমাদের প্রবীণ সমাজ যখন বয়সের ভারে হয়ে পড়ে ন্যুব্জ, হারিয়ে ফেলে স্বাভাবিক চলাফেরার শক্তি, তখন কি আমরা তাদের দিকে সেই ভালোবাসা বা নির্ভরতার হাত বাড়িয়ে দিতে পারি না? কখনও কি প্রবীণদের সম্মানের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করি ভালো আছেন তো? আমাদের নবীন সমাজ তাদের নিজেদের নিয়ে, নিজের পরিবার নিয়ে, নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে এত ব্যস্ত যে প্রবীণদের কথা মনেই থাকে না।
নিজের বাসভূমি, শেকড়, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া প্রবীণদের সংখ্যা পৃথিবী জুড়ে বাড়ছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, নানা কারণে শিশুর জন্ম কমছে, তবে বাড়ছে বয়স্ক মানুষ। ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীজুড়ে ৬০ বা বেশি বয়সের প্রবীণের সংখ্যা শিশুর সংখ্যা থেকে ছাড়িয়ে যাবে। পুরো পৃথিবীতে জনসংখ্যাগত এ পরিবর্তন ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, প্রতিষ্ঠান, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনে প্রভাব ফেলবে। বাংলাদেশ সরকারের হিসাব অনুযায়ী, ১৯৭১ সালে প্রবীণের সংখ্যা ছিল ২৫ লাখ। ২০২৫ সালের মধ্যে এ সংখ্যা প্রায় দুই কোটি পেরিয়ে যাবে।
নিজের বাসভূমি, শেকড়, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া প্রবীণদের সংখ্যা পৃথিবী জুড়ে বাড়ছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, নানা কারণে শিশুর জন্ম কমছে, তবে বাড়ছে বয়স্ক মানুষ। ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীজুড়ে ৬০ বা বেশি বয়সের প্রবীণের সংখ্যা শিশুর সংখ্যা থেকে ছাড়িয়ে যাবে। পুরো পৃথিবীতে জনসংখ্যাগত এ পরিবর্তন ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, প্রতিষ্ঠান, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনে প্রভাব ফেলবে। বাংলাদেশ সরকারের হিসাব অনুযায়ী, ১৯৭১ সালে প্রবীণের সংখ্যা ছিল ২৫ লাখ। ২০২৫ সালের মধ্যে এ সংখ্যা প্রায় দুই কোটি পেরিয়ে যাবে।
বার্ধক্য প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী জীবনের শেষ অধ্যায়। একে অস্বীকার করা যায় না। তাই পৃথিবীজুড়ে বয়স্ক মানুষের চিকিৎসাসেবা, অর্থনৈতিক সহায়তা দিতে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। এমনকি নিচ্ছেও। কিন্তু এ দেশে পদক্ষেপ আটকে থাকে কাগজ-কলম আর সরকার পরিচালকদের ঠোঁট পর্যন্তই। কয়েক বছর আগে সরকার প্রবীণদের ‘সিনিয়র সিটিজেন’ হিসেবে ঘোষণা করে। এ ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে বাস্তবমুখী কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। প্রবীণদের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় করার দাবি দীর্ঘদিনের। এ দাবি বাস্তবায়নে কোনো সরকারই উদ্যোগ নেয়নি। জাতীয় প্রবীণ নীতিমালার আজ অবধি বাস্তবায়ন হয়নি। তাদের সামগ্রিক উন্নয়নের লক্ষ্যে এ নীতিমালা ২০০৬ সালের ১০ অক্টোবরে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় অনুমোদন করে। ২০০৭ সালের ৭ জানুয়ারি নীতিমালাটি নিজ নিজ ক্ষেত্রে বাস্তবায়নের জন্য সব সরকারি দফতর ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে নির্দেশনা পাঠানো হয় ওই মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে। তবে বাস্তবায়নের ঘরটা এখনো শূন্যেই আটকে আছে।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এ পৃথিবী, সভ্যতা, সমাজ ও সংসার সাজাতে প্রবীণদের অবদানও অনেক। প্রবীণ মানেই আমাদের পিতা-মাতা, দাদা-দাদী কিংবা নানা-নানী। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী ভরণপোষণ বলতে জীবিকা নির্বাহের জন্য খাওয়া, পরা ও থাকার সংস্থানকে বুঝায়। মাঝে মাঝে কিছু টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করাকে ভরণপোষণ বলে না। শুধুমাত্র খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান হলেই ভরণপোষণ সংজ্ঞাটি সম্পূর্ণ নয়। শিক্ষার খরচ এবং শরীর ও মানসিক পুষ্টির জন্য যাবতীয় বিষয়ও এই সংজ্ঞার অন্তর্ভূক্ত হবে। কাজেই সংসদে পাসকৃত আইনটি যেনো কাগজে-কলমে না থেকে বাস্তবে রুপ নেয়-এই শুভ কামনায়।

Comments
Post a Comment