কোর্ট ম্যারেজ, প্রতারনা ও প্রাসঙ্গিক আইন

কোর্ট ম্যারেজ, প্রতারনা ও প্রাসঙ্গিক আইন


ময়না ও সুজন একে অপরকে গভীরভাবে ভালবাসে। ভালবাসাকে বাস্তবে রুপ দিতে ওরা পরিবারের অমতে আদালতের নোটারী পাবলিকের কার্যালয়ে গিয়ে ‘কোর্ট ম্যারেজ’ করে। কিন্তু তখন তারা বিয়ের কাবিন রেজিষ্ট্রী করেনি। বিয়ের কিছুদিন পরই সুজন ময়নার সঙ্গে তার বিয়ের কথা পুরোপুরি অস্বীকার করেন। আর এ অজুহাতে ময়নাকে মোহরানা, খোরপোষ ও দাম্পত্য অধিকার দিতেও তিনি রাজি নন। অবশেষে বিষয়টি গড়ায় আদালতে। বিয়েটা প্রমাণ করতে রীতিরকম হিমশিম খেতে হয় ময়নাকে। কাবিন রেজিষ্ট্রীর পরিবর্তে কোর্টম্যারেজ অধিকতর শক্তিশালী এ ভুল ধারণার ফাঁদে পড়ে অনেক নারী তাদের দাম্পত্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
আইনের ছদ্মাবরণে একশ্রেণীর নোটারী পাবলিক এ অবৈধ কাজে সহায়তা করে চলেছেন। অথচ বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে ‘কোর্ট ম্যারেজ’ এর কোন বৈধতা নেই, এমনকি এর কোন অস্তিত্বও নেই। ৫০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে নোটারি পাবলিকের কার্যালয়ে কিংবা ১৫০/-টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিষ্ট্রেটের কার্যালয়ে গিয়ে হলফনামা করাকে বিয়ে বলে অভিহিত করা হয়। অথচ এ্যাফিডেভিট বা হলফনামা শুধুই একটি ঘোষণাপত্র। আইনানুযায়ী কাবিন রেজিষ্ট্রী সম্পন্ন করেই কেবল ঘোষণার জন্য এফিডেভিট করা যাবে। কিন্তু এ নিয়ম মানা হয় না।
মুসলিম বিবাহ ও বিচ্ছেদ বিধি ১৯৭৫ এর ১৯(৩) ধারা অনুযায়ী ‘নিকাহ রেজিষ্ট্রার ব্যতীত অন্য কোন ব্যক্তি যদি বিবাহ করান তাহলে সেই ব্যক্তি ১৫ দিনের মধ্যে ওই নিকাহ রেজিষ্ট্রারের নিকট অবহিত করবেন, যার এলাকায় উক্ত বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে।’ মুসলিম বিবাহ ও বিচ্ছেদ আইন ১৯৭৪-এর ধারা ৫ (২) অনুযায়ী বিবাহ রেজিষ্ট্রশন না করার শাস্তি সর্বোচ্চ তিন মাসের কারাদন্ড কিংবা ৫০০ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত করার বিধান রয়েছে। বিয়ে রেজিষ্ট্রী না করে শুধুমাত্র হলফনামায় ঘোষণা দিয়ে ঘর-সংসার করার প্রবণতা অমাদের দেশে ক্রমেই বাড়ছে। অথচ এর কোন বৈধতা নেই। বিশেষ কয়েক শ্রেণীর নারী-পুরুষের মধ্যে এরকম বিয়ের প্রবণতা বেশী দেখা যায়। তন্মধ্যে গার্মেন্টস শ্রমিক, যৌন কর্মী এবং বিশেষ প্রেম-ঘটিত তরুণ-তরুণী। আবেগঘন সিদ্ধান্ত নিয়ে অনেক তরুন-তরুণীর ভুল ধারণা হয় যে, শুধুমাত্র এ্যাফিডেভিট করে বিয়ে করলে বন্ধন শক্ত হয়। কাজী অফিসে বিয়ের জন্য বিরাট অঙ্কের ফিস দিতে হয় বলে কোর্ট ম্যারেজকে অধিকতর ভাল মনে করে নিম্নবিত্ত শ্রেণীর নারী-পুরুষেরা। অন্যদিকে যৌনকর্মীরা অনেক সময় ঠিকানা বদল করে স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে অবস্থানের সুবিধার কথা বিবেচনা করে কোর্ট ম্যারেজে উৎসাহ হয় অধিক। অনেকে এ্যাফিডেভিটের মাধ্যমে বিয়ে সম্পাদন করে একাধিক বিয়ের কথা গোপন করার জন্য। কোন মেয়ের অভিভাবককে জিম্মি করে টাকা আদায় কিংবা সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্যও অনেক সময় এ্যাফিডেভিটের মাধ্যমে ভূয়া বিয়ের দলিল তৈরী করা হয়। এ দলিল তৈরী করা খুব সহজেই সম্ভব এবং এসব ক্ষেত্রে হলফনামা প্রার্থীকে নোটারি পাবলিকের কাছে হাজির হতে হয় না। এর ফলে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের ক্ষেত্রে বয়স বাড়িয়ে দেয়ার সুযোগ থাকে। এছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতন মামলা থেকে রক্ষার জন্য আসামী পক্ষের এরকম হলফনামা তৈরীর প্রবণতা দেখা যায়।
২০০৯ সালের জুনে কুষ্টিয়া বালিকা বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী জান্নাতুন নূর পপিকে একই এলাকার রবিউল হাসান অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে ১৫০ টাকার নন-জুডিসিয়ল স্ট্যাম্পে জোরপূর্বক স্বাক্ষর নিয়ে এফিডেভিট করে রবিউল। থানায় পপির চাচা মামলা করলে পুিলশ তাকে উদ্ধার করে। পপির পরিবারের অভিযোগ তাদের পরিবারকে হেয় করার উদ্দেশ্যেই পপিকে অপহরণ করে মিথ্যা বিয়ের ফাঁদ পাতা হয়েছে। অন্যদিকে এ্যাফিডেভিট কিংবা ‘ডিড অব সেপারেশনে’র মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ কখনও আইনসঙ্গত নয়। মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার এক কেস স্টাডিতে দেখা যায়, সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী সাথী ও বিদ্যুৎ এফিডেভিটের মাধ্যমে বিয়ে সম্পাদন করে। তাদের সংসারে একটি কন্যা সন্তানও রয়েছে। কিন্তু ঘটনা পরষ্পর তাদের দাম্পত্য জীবন বেশী দূর এগোয়নি। পরে তারা স্বেচ্ছায় বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে নোটারি পাবলিকের কার্যালয়ে একটি হলফনামা সম্পাদন করেন। হলফনামাটি একটি সাব-রেজিষ্ট্রি অফিসে রেজিষ্ট্রি করে। কিন্তু বিবাহ বিচ্ছেদের এ ধরণের দলিল রেজিষ্ট্রি করা ও এ্যাফিডেভিট করা সম্পূর্ণ বে-আইনী। হিন্দু আইনে বিবাহ বিচ্ছেদ বলে কিছু নেই। সঙ্গত কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ চাইতে হবে পারিবারিক আদালতে। খ্রিষ্টান আইনেও বিবাহ একটি চুক্তি, যা ভঙ্গ করা যায় না। ১৮৬৯-এর বিবাহ বিচ্ছেদ আইন অনুযায়ী খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীরা বিয়ে করার জন্য আদালতে যেতে পারেন।
বিয়ে রেজিষ্ট্রেশন হচ্ছে সরকারের নির্ধারিত ফরমে লিখিত বর ও কনের বিয়ে সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় তথ্যাবলী সম্বন্ধে আইনগত দলিল যা কাজী অফিসে সংরক্ষিত থাকে। সরকার কাজীদের বিয়ে রেজিষ্ট্রী করার জন্য অনুমতি বা লাইসেন্স দিয়ে থাকেন। লাইসেন্স বিহীন কাজীর নিকট বিয়ে রেজিষ্ট্রী করলে এর কোন আইনগত মূল্য নেই। কাজীর কাছে গিয়ে কাবিন না করলে দু’পক্ষই ক্ষতিগ্রস্থ হয়। কাবিননামা না থাকায় নারীরা তাদের মোহরানাও পায় না। কাবিননামার বদলে কোর্ট ম্যারেজের বিয়েতে ছেলেরা একটা সুযোগ খুঁজে। জোর করে দস্তখত নিয়ে এ্যাফিডেভিট করেছে মেয়ে পক্ষ এই অজুহাত অনেক সময় দাঁড় করে ছেলে পক্ষ। আইনানুযায়ী বিয়ের আসরেই বিয়ে রেজিষ্ট্রি করতে হয়। বিয়ের আসরে সম্ভব না হলে বিয়ে অনুষ্ঠানের দিন থেকে ১৫ দিনের মধ্যে কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে রেজিষ্ট্রী করতে হয়। কাজীকে বাড়িতে ডেকে এনে অথবা কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে রেজিষ্ট্রী করা যায়। এছাড়াও কাবিননামার সকল কলাম পূরণ করার পর বর, কনে, উকিল, সাক্ষী ও অন্যন্যা ব্যক্তিগণের স্বাক্ষর দিতে হয়। এদেশের সব ধর্মের বিয়ে বিচ্ছেদের ব্যাপরে পারিবারিক আইন আদালতের নিয়ম মানতে হয়। কোর্ট ম্যারেজের বিয়েতে উৎসাহিতকারী নোটারি পাবলিকদের চিহ্নিত করে শাস্তির বিধান করতে হবে। আইন করে কোর্ট ম্যারেজের বিয়ে বন্ধ করা উচিত।

Comments

Popular posts from this blog

শোন এরেস্ট (Shown Arrest) কাকে বলে ? ..শিশুদের গ্রেপ্তারে হাতকড়া পরানো যাবেনা

জেনে নিন ভায়োলেশন কেইস সম্পর্কে

Detention (ডিটেনশন) কি ? একজন ব্যক্তিকে কতদিন বিনা বিচারে আটক রাখা যায় ?ইম্পয়াউনড কেস -Impound Case ঃ