কাবিননামা ছাড়া স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে বসবাস করলেেও বৈধ বিয়ের অস্থিত্ব

কাবিননামা ছাড়া স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে বসবাস করলেেও বৈধ বিয়ের অস্থিত্ব

আপিল বিভাগের রায় কাবিননামা ছাড়া স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে বসবাস করলে বৈধ বিয়ের অস্থিত্ব বিদ্যমান থাকতে পারে।
মমতাজ বেগম বনাম আনোয়ার হোসেন মামলায় আপিল বিভাগের রায়ে বিচারপতি এস কে সিনহা মন্তব্য করেছেন, মুসলিম নর ও নারী যদি স্বামী ও স্ত্রীর পরিচয়ে দীর্ঘদিন বসবাস করেন এবং তাঁদের মধ্যে যদি রেজিস্ট্রিকৃত কাবিননামা না-ও হয়ে থাকে, তাহলেও এখানে বৈধ বিয়ের অস্থিত্ব বিদ্যমান থাকতে পারে।
তারা উভয়ে স্বামী-স্ত্রী এবং তাদের মধ্যে মুসলিম আইন অনুযায়ী বৈধ বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে বলেও গন্য হতে পারে। মামলার রায়টি আসে ৩১ জুলাই ২০১১। বিচারপতি এস কে সিনহার রায়ে আপিল বিভাগের অন্য বিচারপতিরা সম্মতি দিয়েছেন।
মামলাটির ঘটনায় জানা যায়, মমতাজ বেগম ও আনোয়ার হোসেন দীর্ঘদিন স্বামী ও স্ত্রী হিসেবে বসবাস করে আসছিলেন। একপর্যায়ে লোভী আনোয়ার হোসেন মমতাজ বেগমের কাছ থেকে যৌতুক দাবি করতে থাকেন এবং যৌতুক না দেওয়ার কারণে মমতাজ বেগমকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন। মমতাজ বেগম তাঁর ভরণপোষণ এবং দেনমোহর চেয়ে পারিবারিক আদালতে মামলা ঠুকে দেন। এই মামলায় আনোয়ার হোসেন জবাব দাখিল করে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। মামলার জবাবে আনোয়ার হোসেন মমতাজ বেগমের সঙ্গে তাঁর বিয়েকে অস্বীকার করেন।
মমতাজ বেগম দাবি করেন, তাঁদের মধ্যে মুসলিম আইন অনুযায়ী বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে এবং তাঁরা দীর্ঘদিন স্বামী-স্ত্রী হিসেবেই একত্রে বসবাস করছেন এবং স্বামী-স্ত্রী হিসেবেই পরিচয় দিয়েছেন। মামলার সাক্ষী-প্রমাণ শেষে পারিবারিক আদালত আদেশ দেন, তাঁদের মধ্যে বিয়ের অস্তিত্ব বিদ্যমান রয়েছে। আনোয়ার হোসেন ১৯৯৬ সালে হাইকোর্ট বিভাগে রিভিশন দায়ের করেন পারিবারিক আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে। হাইকোর্ট বিভাগের একটি একক বেঞ্চ পারিবারিক আদালতের মামলাটি খারিজ করে দেন ১৯৯৯ সালে। হাইকোর্ট বিভাগ তাঁর রায়ে বলেন, তাঁদের মধ্যে কোনো প্রকার কাবিননামা সম্পন্ন হয়নি যা বিয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এবং মমতাজ বেগম তা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁরা মোহামেডান আইনের ২৫২ প্যারাগ্রাফ অনুযায়ী বিয়ে সম্পন্ন করে একত্রে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বসবাস করেননি এবং এই একত্রে থাকা কোনো বিয়ের বাধ্যবাধকতার পর্যায়ে পড়ে না।
হাইকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে মমতাজ বেগম লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি) দায়ের করেন এবং আপিল মঞ্জুর হয় তিনটি বিষয়কে বিবেচনা করে:
১. মুসলিম আইন অনুযায়ী বিয়ে রেজিস্ট্রি না হলে এটি কি বাতিল, অবৈধ বা অস্তিত্বহীন কি না।
২. তিন বছর ধরে তাঁদের স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বসবাস করা এবং বসবাসের শর্ত বৈধ বিয়ে হিসেবে গণ্য হবে কি না।
৩. হাইকোর্ট রিভিশনাল এখতিয়ার প্রয়োগ করে নিু আদালতের আদেশ এবং পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের মাধ্যমে বৈধ বিয়ের অস্তিত্বের বিষয়ে বিবেচনা করেছেন কি না।
আপিল বিভাগে মমতাজ বেগমের পক্ষে আপিলটি করেন আইনজীবী ব্যারিস্টার রাবেয়া ভূঁইয়া ২০০৩ সালে (সিভিল আপিল নম্বর-১৩৯/২০০৩)। তিনি আপিলে দাবি করেন, কাবিননামার অনুপস্থিতিতে বিয়ের অস্তিত্ব প্রমাণ করা যাবে নাÑহাইকোর্ট বিভাগের এ বিবেচনা যুক্তিসংগত নয় এবং তা আইনের সঠিক মর্ম নয়।
আপিল বিভাগ রায়ে বলেন, হাইকোর্ট বিভাগ স্বামী-স্ত্রী হিসেবে তিন বছর বসবাসের বিষয়টিকে প্রাধান্য না দিয়ে শুধু রেজিস্টার্ড কাবিননামা নেই এ বিষয়ে অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। হাইকোর্ট বিভাগ যদিও বিশ্বাস করেছেন তাঁরা লিভ টুগেদার করেছেন স্বামী-স্ত্রী হিসেবে কিন্তু এমন বসবাসকে অনৈতিক হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। হাইকোর্ট বলেছেন, ‘বর্তমান সময়ে লিভ টুগেদারের মতো অনৈতিক বিদেশি সংস্কৃতি আমাদের সমাজে ঢুকে পড়েছে এবং ধীরে ধীরে আমাদের সমাজকে কলুষিত করছে, সামাজিক মূল্যবোধকে নষ্ট করছে এবং বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করছে।’
বিচারপতি সিনহা মন্তব্য করেন, হাইকোর্ট বিভাগ পক্ষদ্বয়ের মধ্যে বিরোধীয় বিষয়ে পর্যাপ্ত সাক্ষ্য এবং মামলার ঘটনায় আইনের আদর্শের দিকটি বিবেচনার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছেন।
তিনি তাঁর রায়ে বলেন, ‘মুসলিম আইন অনুযায়ী আমাদের বিয়ের ধারণা সম্পর্কে বিবেচনা করতে হবে। মুসলিম আইন অনুযায়ী বিয়ে হচ্ছে একটি দেওয়ানি চুক্তি এবং এতে কোনো অনুষ্ঠান বা বিশেষ কোনো আনুষ্ঠানিকতার দরকার নাই।’
আরেকটি প্যারায় উল্লেখ করেছেন, ‘মুসলিম বিয়ে একটি দেওয়ানি চুক্তি এবং এটি কোনো প্রথা ন। এ বিষয়ে কোনো বিরোধ নেই। নর-নারীর মধ্যে বৈধ যৌন সম্পর্ক এবং সন্তান জন্মদানের জন্য একটি স্থায়ী চুক্তি হচ্ছে বিয়ে, যারা বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। মুসলিম বিয়ে সম্পন্ন হতে হলে বিয়ের চুক্তি লিখিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। পুরো বিয়ের প্রক্রিয়াটির বৈধতা এবং কার্যকরতা নির্ভর করে বিয়ের প্রস্তাব এবং প্রস্তাব গ্রহণ এবং উপযুক্ত সাক্ষীদের সামনে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার মধ্য দিয়ে।’
আপিল বিভাগের এ রায়ে তায়েবজি, ডি এফ মোল্লা, সৈয়দ আমীর আলীর বিভিন্ন বক্তব্য ও বিশ্লেষণ উল্লেখ করেছেন। আপিল বিভাগের রায়ে সৈয়দ আমীর আলীর একটি বক্তব্য উল্লেখ করা হয়, ‘মোহামেডান আইনে কোনো চুক্তির কার্যকরতার বিষয়ে কোনো নির্দিষ্ট কাঠামো নেই যে বিষয়টি লিখিত হতে হবে কি না নাকি সাক্ষীদের উপস্থিতি এর বৈধতার জন্য প্রয়োজন কি না। যদিও সুন্নিদের মধ্যে বিয়ের বৈধতার জন্য সাক্ষীদের উপস্থিতির প্রয়োজন রয়েছে। যদি সাক্ষীদের উপস্থিতির অভাবে কোনো বৈধ বিয়ে প্রমাণ করা দুঃসাধ্য হয়ে যায় তাহলে বিয়ে সংঘটনের বিষয়টি প্রমাণ করতে পারলে এটি বৈধ বিয়ে বলে গণ্য হবে।’
রায়ে উল্লেখ করা হয়, সাক্ষ্য আইনের ৫০ ধারায় বলা হয়েছে, যখন এক ব্যক্তির সঙ্গে অন্য ব্যক্তির সম্পর্কের ব্যাপারে আদালতকে অভিমত নিতে হয় তখন পরিবারের সদস্য হিসেবে অথবা অন্যভাবে এই ব্যাপারে যা জ্ঞানলাভের সুযোগ আছে, উক্ত সম্পর্কের অস্তিত্ব সম্পর্কে তার আচরণের মাধ্যমে যে অভিমত ব্যক্ত হয় তা প্রাসঙ্গিক বিষয়।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, প্রশ্ন হচ্ছে, ক ও খ পরস্পর বিবাহিত কি না। তাদের বন্ধুবান্ধব সাধারণত তাদের স্বামী-স্ত্রী হিসেবে অভ্যর্থনা করে এবং তাদের সঙ্গে তদ্রƒপ ব্যবহার করেÑএটা প্রাসঙ্গিক ঘটনা।
রায়ে বলা হয়, যখন কোনো নারী অনেক বছর ধরে কোনো নরের এবং সন্তানদের সঙ্গে বসবাস করে এবং সন্তানের জš§দাতা হিসেবে লোকটি স্বীকৃতি দেয় এবং আÍীয়স্বজন এবং প্রতিবেশীরা তাদের সঙ্গে তেমনভাবে আচরণ করে, তাহলে বিয়ের বৈধতার বিষয়ে অনুমান করা যায়। এ বিষয়ে নর-নারীর মধ্যে সম্পর্কের বিষয়টি তাদের আÍীয়স্বজন এবং প্রতিবেশীদের সাক্ষ্যের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে পারেন আদালত।
এটা স্বীকৃত যে বিয়েটা আইনে মনোনীত একজন কাজির মাধ্যমে পড়ানো হয়। আরও দুইজন মনোনীত ব্যক্তি থাকেন যাঁরা পক্ষদ্বয় দ্বারা মনোনীত হন এবং শর্তগুলো চুক্তিপত্রের মাধ্যমে বলবৎ করা হয়, যাকে বলা হয় কাবিননামা।
সাক্ষী ছাড়া একটি বিবাহের চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার বৈধতা নেই। কিন্তু যখন এমন কোনো স্থানে বিয়ের চুক্তি সম্পন্ন হয় যেখানে এর কার্যকরতা বলবৎ করা যায় না, শুধু এ কারণে বিয়েটি অবৈধ হয়ে যাবে না। যেখানে সাক্ষ্য নেওয়া সম্ভব কিন্তু সাক্ষী রাখা হয়নি সে ক্ষেত্রে বিয়েটি অবৈধ হবে। একবার বিয়ে হলে এবং উভয় যদি একত্রে বসবাস করতে থাকে তাহলে চুক্তিগত ত্র“টিগুলো অকার্যকর হয়ে যায় এবং বিয়েটি আইনগত বৈধতা পায়।
বিচারপতি সিনহা মন্তব্য করেন, অনেক জুরিস্ট ও বিজ্ঞ লোকের অভিন্ন মতামত আছে যে কোনো বিয়ের বৈধতার বিষয়ে আনুষ্ঠানিক প্রমাণ না থাকলে সে ক্ষেত্রে আচরণ এবং প্রচারের সাক্ষ্যপ্রমাণ এবং বিয়েটি সম্পন্ন হওয়ার ধরনের প্রশ্ন বিয়েটির বৈধতার উপাদান হিসেবে গণ্য হতে পারে।
স্বামী-স্ত্রী হিসেবে সম্পর্ক অবসানের পর বিয়েটি সম্পন্ন হওয়ার অনুমান সম্পর্কে প্রশ্ন উঠেছে। সেই স্থানে কোনো তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি থাকবে না এবং এ জায়গাটি পাবলিক রাস্তা, গোসলখানার মতো হবে না। যে স্থানে তারা স্বামী-স্ত্রীর মতো দীর্ঘদিন বসবাস করেছে যা কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ ছাড়াই এখানে বিয়ের বৈধতা নিয়ে অনুমান করা যায়। আইনে বিয়ের চুক্তির জন্য কোনো নির্দিষ্ট অনুষ্ঠানের কথা বলা নেই। একটি বিয়ে কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই হতে পারে এবং এমনকি প্রত্যক্ষ কোনো প্রমাণ ছাড়াই পরোক্ষ প্রমাণই যথেষ্ট হতে পারে।
আপিল বিভাগের রায় হচ্ছে, হাইকোর্ট বিভাগ যদি মোহামেডান আইনের ২৫৪ এবং ২৬৮ প্যারা বিশ্লেষণ করতেন তাহলে বিয়েটির বৈধতা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত অন্য কিছু হতে পারত। তাই এ মামলার রায় প্রদানে আইনের ভুল ব্যাখ্যা হয়েছে। নথিপত্রের সমস্ত সাক্ষ্য প্রমাণ করে যে মমতাজ বেগম তথা আপিলকারী এবং আনোয়ার হোসেন তথা প্রতিবাদীর মধ্যে বৈধ বিয়ের অস্তিত্ব বিদ্যমান রয়েছে।

Comments

  1. This is judgement. Its true & nature. Congrats & wishing to lot S.K Sin-ha Sir (appellate division) respectfully decision. Also thanks for who given the post.

    With Regards
    Mozammel Hossain Sumon
    LL.B Hon's, LL.M
    Cell No: 01712697021

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

জেনে নিন ভায়োলেশন কেইস সম্পর্কে

** 'হেবা' ও 'হেবা-বিল-এওয়াজ' কী? **

শোন এরেস্ট (Shown Arrest) কাকে বলে ? ..শিশুদের গ্রেপ্তারে হাতকড়া পরানো যাবেনা