কিশোর অপরাধ এবং এ সংক্রান্ত আইন কিশোর অপরাধ কি?
কিশোর অপরাধ এবং এ সংক্রান্ত আইন
কিশোর অপরাধ কি?
------------------
বাংলাদেশে ৭-১৬ বছর বয়সী শিশুদের
কিশোর বলা হয়। এই কিশোররা যখন
অপরাধমূলক কাজে জড়িত হয় তখন তাদের
কিশোর অপরাধী হিসেবে গন্য করা হয়।
যখন তাদের সমাজবিরোধী কার্যকলাপ
খুব স্বল্পমাত্রা হতে মারাত্মক আকার
ধারণ করে, তখন অনেক সময় তাদের শিশু
আইনের অধীনে বিচার করা হয়।
বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী ভিন্ন ভিন্ন
ভাবে কিশোর অপরাধের সংজ্ঞা
দিয়েছেন।
(১) সমাজবিজ্ঞানী সালমানের মতে,
কিশোর অপরাধ বলতে অপ্রাপ্ত বয়স্ক
জনগোষ্ঠীর ওপর পরিবার ও সমাজের
নিয়ন্ত্রণ হীনতা বুঝায়;
(২) বিসলারের মতে, কিশোর অপরাধ
হচ্ছে প্রচলিত সামাজিক নিয়মকানুনের
ওপর অপ্রাপ্ত বয়স্ক কিশোরদের অবৈধ
হস্তক্ষেপ;
(৩)ডুবের মতে, 'শিশু ও কিশোরদের
দ্বারা সংঘটিত সামাজিকভাবে
নির্ধারিত কোনো কাজ যদি
প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী নির্ধারিত
আইনের আওতায় আসে তবে তা
কিশোর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত
হবে।'
(৪) বার্ট এর মতে, 'কোনো শিশুকে
তখনই অপরাধী বলে মনে করতে হবে যখন
তার অপরাধ ও অমানবিক কাজের
প্রবণতার জন্য আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের
প্রয়োজন হয়ে পড়ে।'
উপরোক্ত সংজ্ঞা থেকে আমরা ধরে
নিতে পারি যে, অপ্রাপ্ত বয়স্কদের
দ্বারা সংঘটিত সমাজ ও আইন বিরোধী
এবং রীতিনীতি ও মূল্যবোধের
পরিপন্থি কার্যকলাপই হচ্ছে কিশোর
অপরাধ।
কিশোর অপরাধী
প্রতিটি সমাজে আমরা দেখতে পাই,
কিছু লোক আছে যারা সমাজের এসব
আদর্শ ও মূল্যবোধকে মেনে চলে এবং
কিছু লোক আছে যারা সেগুলোকে
লঙ্ঘন করে। এসব ব্যক্তিবর্গ সমাজের
শান্তি ও ঐক্যকে ব্যাহত করে এবং
এদের বলা হয় অপরাধী। যখন অল্পবয়সী
শিশু কিশোররা এসব সামাজিক
আদর্শকে লঙ্ঘন করে এবং অপরাধীর মতো
আচরণ করে তখন তাদের কিশোর
আদালতের অধীনে বিচার করা হয়। এসব
শিশু কিশোরদের বলা হয় কিশোর
অপরাধী।
অপরাধের লক্ষণ
অপরাধী শিশুরা বিপথগামী এবং
তারা বিশৃঙ্খল ও সমাজ বিরোধী আচরণ
করে থাকে। সে কারণে স্বাভাবিক
শিশুদের থেকে এসব বিপথগামী
শিশুদের আচরণ ভিন্ন প্রকৃতির হয়ে
থাকে। যেহেতু তারা সমাজ বিরোধী
আচরণের সাথে জড়িত সে কারণে
তাদের মাঝে ধ্বংসাত্মক মেজাজ
এবং আক্রমণাত্মক আচরণ দেখা যায়।
তাদের অপরাধমূলক কিছু লক্ষণ নিম্নরূপ-
(ক) এসব শিশুদের মাঝে সমাজবিরোধী
চিন্তা লক্ষ্য করা যায় এবং তারা
ব্যাপকভাবে ধ্বংসাত্মক
ক্রিয়াকলাপের সাথে জড়িত থাকে;
(খ) মেজাজের দিক দিয়ে এরা
আক্রমণাত্মক এবং উচ্ছৃঙ্খল প্রক্রিতির
হয়ে থাকে;
(গ) শারীরিকভাবে এরা শক্তিশালী
হয়ে থাকে এবং এদের মাঝে দৃঢ়
সংকল্প , সাহসী মনোভাব এবং আচরণ
লক্ষ্য করা যায়;
(ঘ) তারা পরিবার এবং বিদ্যালয়
কর্তৃপক্ষের প্রতি অসহযোগিতামূলক এবং
অনমনীয় হয়ে থাকে। তাদের মধ্যে নতুন
কোন কার্যক্রম সম্পর্কে কর্তৃপক্ষকে প্রশ্ন
এবং বিরোধিতা করার প্রবণতা দেখা
যায়।
(ঙ) তাদের মধ্যে বিষণ্ণতামূলক এবং
অস্থির আবেগিয় ব্যক্তিত্তের লক্ষ্যন
দেখা যায়।
কিশোর অপরাধের কারণঃ-
কিশোর অপরাধের জন্য বহুবিধ কারণ
দায়ী। কোনো নির্দিষ্ট কারণে
অপরাধ সৃষ্টি হয় না। তবে অপরাধ
বিজ্ঞানী, সমাজ বিজ্ঞানী এবং
মনোবিজ্ঞানীগণ অপরাধ বিশ্লেষণ
করে যে প্রধান প্রধান কারণ আবিষ্কার
করেছেন তা নিম্নরূপ-
(১) জৈবিক কারণঃ
মনোবিজ্ঞানীদের মতে, মানুষের
দৈহিক গঠন এবং বৈশিষ্ট্য অপরাধ
প্রবণতার জন্য দায়ী। ত্রুটিপূর্ণ দৈহিক
গঠন, স্নায়ুতন্ত্রের ত্রুটি প্রভৃতি শিশু-
কিশোরদের মাঝে হীনমন্যতাবোধ
এবং অস্বাভাবিক আচরণের সৃষ্টি করে।
ফলে সে পরিবেশের সাথে
স্বাভাবিক উপযোগ স্থাপনে ব্যর্থ
হয়ে অপরাধ প্রবণ হয়ে ওঠে
(২) বংশগত কারণঃ বংশের কেও
অপরাধী হয়ে থাকলে তাঁর পরবর্তী
প্রজন্ম অপরাধী হতে পারে। এটা জিন
দ্বারা বাহিত হয়। তবে এর পক্ষে
বিপক্ষে নানা মত আছে।
(৩) মনবৈজ্ঞানিক কারনঃ অপরাধ
মনোবিজ্ঞানী গডার্ড এ ধরণের অপরাধ
প্রবণতার জন্য মানসিক অক্ষমতা বা
দোষত্রুটি কে দায়ী করেছেন।
মানসিক বৈকল্য এবং অসুস্থতার সঙ্গে
অপরাধ প্রবণতা প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত।
শিশুদের অপরাধ প্রবণতার জন্য যে সকল
মানসিক কারণ দায়ী তা নিম্নরূপঃ
(ক) প্রত্যাখাত শিশু
(খ) অতিরিক্ত আদর ও স্নেহ
(গ) অতিশাসন
(ঘ) পারিবারিক ও দাম্পত্য কলহ
(ঙ) অসামঞ্জস্য পূর্ণ আচরণ
(চ) পিতা-মাতার অতি উচ্চাশা
(ছ) নিরাপত্তা বোধের অভাব
(৪) পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক কারণঃ
পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক কারণকে
নিম্নোক্ত ভাগে ভাগ করা যায়।
(ক) দারিদ্র্য
(খ) বিপর্যস্ত গৃহ
(গ) বহিঃজগতের পরিবেশ
(ঘ) অস্বাস্থ্যকর বিদ্যালয় প্রথা
(৫) সামাজিক কারণঃ শিশুকিশোরদের
অপরাধ প্রবণতা সামাজিক
কুসংস্কারের জন্য অনেকটা দায়ী ।
সামাজিক কারণের আওতায় যে সকল
অপরাধ প্রবণতা দেখা যায় তা নিম্নরূপ-
(ক) পারিবারিক ভাঙ্গন,বিচ্ছেদ,
বিবাহ বিচ্ছেদ
(খ) দাম্পত্য কলহ
(গ) সামাজিকীকরণের অভাব
(ঘ) চিত্তবিনোদনের অভাব
(ঙ) বিদেশি চিত্তবিনোদন ও
সংস্কৃতির অভাব
(চ) ত্রুটিপূর্ণ সামাজিক পরিবেশ
কিশোর অপরাধ আইনঃ
পৃথিবীর অনেক দেশের মতোই
বাংলাদেশেও শিশু অপরাধীদের
বিচার ও সংশোধনের জন্য পৃথক আইন,
আদালত এবং সংশোধনআগার রয়েছে।
২০১৩ সালের শিশু আইনটি কার্যকর আইন।
এটি শিশুদের অধিকার ও বিচারের
ক্ষেত্রে একটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন
আইন। এই আইনে প্রাপ্তবয়স্ক অপরাধীদের
সাথে একই আদালতে বা কার্যক্রমের
মতো শিশুদের বিচার না করার বিধান
রয়েছে। আইনে শিশু অপরাধীদের
বিচারের চেয়ে তাদের সংশোধনের
বিষয়টি বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
বর্তমানে আমাদের দেশে ৩ টি
কিশোর আদালত রয়েছে। এগুলো টঙ্গি,
যশোর এবং কোনাবাড়িতে অবস্থিত।
সরকারি গ্যাজেট প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী
টঙ্গি আদালতের অধীনে আছে ঢাকা
চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগ। এবং
যশোরের মধ্যে আছে খুলনা,রাজশাহী ও
বরিশাল বিভাগ। অন্যদিকে
কোনাবাড়িতে শুধু মেয়ে শিশুদের
আদালত ও সংশধনাগার অবস
এই আইনের অধীনে শিশুদের হাতকড়া
পরানো বা কোমরে বেড়ি বা রশি
ইত্যাদি পরানো নিষেধ।
একটি শিশু কোন অপরাধে গ্রেপ্তার
হলে বিষয়টি পুলিশ প্রথমে প্রবেশন
কর্মকর্তাকে জানাবেন। এর মাধ্যমে
প্রথমে শিশুকে একজন প্রবেশন কর্মকর্তার
কাছে হস্তান্তরের মাধ্যমে তাকে মূলত
সংশোধনমূলক প্রক্রিয়ায় হস্তান্তর করা
হয়। প্রবেশন কর্মকর্তার তদন্ত
প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই আদালত
পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে।
শিশু আইন ২০১৩ এর ধারা-৪ অনুযায়ী,
বিদ্যমান অন্য কোন আইনে ভিন্নতর
যাহা কিছুই থাকুক না কেন, এই আইনের
উদ্দেশ্যপূরণকল্পে, অনুর্ধ্ব ১৮ (আঠার) বৎসর
বয়স পর্যন্ত সকল ব্যক্তি শিশু হিসাবে গণ্য
হইব
শিশু আইন ২০১৩ এর ধারা ২(৩) অনুযায়ী
‘আইনের সহিত সংঘাতে জড়িত শিশ
(Children in Conflict with the Law)’ অর্থ এমন
কোন শিশু যে, দণ্ডবিধির ধারা ৮২ ও ৮৩
এ বিধান সাপেক্ষে, বিদ্যমান কোন
আইনের অধীন কোন অপরাধের দায়ে
অভিযুক্ত অথবা বিচারে দোষী
সাব্যস্ত;
আইনের ১৭ ধারায় বলা আছে, যে সকল
দালান বা কামরায় প্রচলিত
আদালতের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়
তাছাড়া যতদূর সম্ভব অন্য কোন দালান
বা কামরায় প্রচলিত আদালতের মতো
কাঠগড়া ও লালসালু ঘেরা
আদালতকক্ষের পরিবর্তে একটি সাধারণ
কক্ষে শিশু আদালতের অধিবেশন বসবে।
আমাদের করণীয়/অপরাধ প্রবণতা দূর
করার উপায়ঃ
অপরাধ প্রবণতা যদিও একটি বয়সের ধর্ম,
তবুও কোনো মানুষ এই অপরাধকে
সুনজরে দেখে না। তাই যতটা সম্ভব
ছেলেমেয়েদের মধ্যে যাতে এ
প্রবণতা সৃষ্টি না হতে পারে তার জন্য
আমাদের আগে থেকেই সতর্ক থাকা
উচিত। অপরাধ প্রবণতা দূর করার জন্য
দু'ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে
পারে। যেমনঃ
(ক) প্রতিরোধমূলক
(খ) প্রতিকার বা সংশোধন মূলক ব্যবস্থা
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাঃ
অপরাধ প্রবণতা দূর করার জন্য
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাগুলো নিম্নরূপ
১। পিতা-মাতাকে সন্তান লালন
পালনের জন্য সুশিক্ষা অর্জন করতে হবে
২। শিশুদের খারাপ সঙ্গ ও অসামাজিক
লোকদের থেকে দূরে রাখা
৩। বিদ্যালয়ের শিক্ষা ও পরিবেশের
মান উন্নয়ন করা
৪। গৃহের পরিবেশ উন্নত করা
৫। শিক্ষার্থীদের মৌলিক চাহিদার
জোগান দেয়া
৬। শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত শিক্ষার
ব্যাবস্থা করা
৭। নৈতিক আদর্শের বিকাশ ঘটানো
৮। সহপাঠ্য ক্রমিক কার্যাবলীর ব্যবস্থা
করা
৯। সামাজিক রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা দূর
করা
১০। রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা অ ন্যায়নীতির
সঠিক প্রয়োগ করা
১১। জীবনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ
পাঠ্যবিষয় শিক্ষাক্রমে অন্তর্ভুক্ত করে
১২। জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের যথার্থ
পদক্ষেপ গ্রহণ করে
১৩। সুন্দর বিনোদনের ব্যবস্থা করে
প্রতিকারমূলক বা সংশোধন মূলক
ব্যবস্থাঃ
যে সকল শিশু ও কিশোর ইতোমধ্যে
নানাবিধ অপরাধের সাথে জড়িত হয়ে
পরেছে তাদের সংশোধনের জন্য
নিম্নলিখিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা একান্ত
প্রয়োজন-
১। শারীরিক ও মানসিক শান্তির
ব্যবস্থা করে
২। সামাজিকভাবে একঘরে না করে
৩। অপ ও কুসংস্কৃতি দূর করে
৪। মনবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা প্রয়োগ
করে
৫। কিশোর অপরাধ কোর্টের মাধ্যমে
বিচারের ব্যবস্থা করে
৬।সংশোধন ও পুনর্বাসনের জন্য বিশেষ
বিদ্যালয়ে বিশেষ শিক্ষার ব্যবস্থা
করে
৭। কিশোর অপরাধীদের বিভিন্ন
ব্যক্তি বা সংস্থার হাতে দায়িত্ব
ন্যস্ত করে
৮। প্রয়োজনে জেল জরিমানা ও অন্য
শাস্তির ব্যবস্থা করে
উপরের বর্ণিত অবস্থা বিবেচনা করে
আমরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি
যে, শিশুকে যোগ্য মানুষ হিসেবে গড়ে
তুলতে হলে বাল্যকাল থেকে ধর্মীয়
বিধিবিধান এবং অনুশাসনের মাধ্যমে
তাদের গঠন করে তুলতে হবে। ধর্মীয়
অনুশাসন প্রত্যকটি মানুষকে শৃঙ্খলার
মধ্যে আবদ্ধ রাখে। যা শিশু এবং
কিশোরদের জন্য খুবই উপকারী।
অভিভাবক হিসেবে আমাদের মনে
রাখতে হবে ধর্মহীন শিক্ষা মূল্যহীন।
শিশু এবং কিশোররা যে শিক্ষা
লাভ করবে তার মধ্যে ধর্মীয় প্রতিফলন
থাকলে তারা বিপদগামী পথে না
গিয়ে শৃঙ্খলার মধ্যে আসবে। তাই
অভিভাবক হিসেবে আমাদের ধর্মীয়
দিকটি বিবেচনা করে তাদের মানুষ
হিসেবে গঠন করে তোলা উচিত।
শিশুরা দেশ ও জাতির আগামী দিনের
দর্পণ। আলোক বর্তিকা। তাদের ওপর
নির্ভর করে আছে আগামী দিনের
ভবিষ্যৎ। তাই তাদের সঠিক যত্ন ও
পরিচর্যা করে আমাদের তৈরি করতে
হবে। শিশুরা যেন নিজেদের বিকশিত
করার সব রকম সুযোগ পায় সে ব্যবস্থা
নিশ্চিত করতে হবে। তার মৌলিক
চাহিদা মিটানোসহ জীবন গড়ার জন্য
সুপরামর্শ ও সঠিক পথ নির্দেশ করতে হবে,
তাহলেই একটি শিশু অপরাধী না হয়ে
সমাজের একজন সুস্থ সরল মানুষ হিসেবে
গড়ে উঠতে পারবে।
কিশোর অপরাধ কি?
------------------
বাংলাদেশে ৭-১৬ বছর বয়সী শিশুদের
কিশোর বলা হয়। এই কিশোররা যখন
অপরাধমূলক কাজে জড়িত হয় তখন তাদের
কিশোর অপরাধী হিসেবে গন্য করা হয়।
যখন তাদের সমাজবিরোধী কার্যকলাপ
খুব স্বল্পমাত্রা হতে মারাত্মক আকার
ধারণ করে, তখন অনেক সময় তাদের শিশু
আইনের অধীনে বিচার করা হয়।
বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী ভিন্ন ভিন্ন
ভাবে কিশোর অপরাধের সংজ্ঞা
দিয়েছেন।
(১) সমাজবিজ্ঞানী সালমানের মতে,
কিশোর অপরাধ বলতে অপ্রাপ্ত বয়স্ক
জনগোষ্ঠীর ওপর পরিবার ও সমাজের
নিয়ন্ত্রণ হীনতা বুঝায়;
(২) বিসলারের মতে, কিশোর অপরাধ
হচ্ছে প্রচলিত সামাজিক নিয়মকানুনের
ওপর অপ্রাপ্ত বয়স্ক কিশোরদের অবৈধ
হস্তক্ষেপ;
(৩)ডুবের মতে, 'শিশু ও কিশোরদের
দ্বারা সংঘটিত সামাজিকভাবে
নির্ধারিত কোনো কাজ যদি
প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী নির্ধারিত
আইনের আওতায় আসে তবে তা
কিশোর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত
হবে।'
(৪) বার্ট এর মতে, 'কোনো শিশুকে
তখনই অপরাধী বলে মনে করতে হবে যখন
তার অপরাধ ও অমানবিক কাজের
প্রবণতার জন্য আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের
প্রয়োজন হয়ে পড়ে।'
উপরোক্ত সংজ্ঞা থেকে আমরা ধরে
নিতে পারি যে, অপ্রাপ্ত বয়স্কদের
দ্বারা সংঘটিত সমাজ ও আইন বিরোধী
এবং রীতিনীতি ও মূল্যবোধের
পরিপন্থি কার্যকলাপই হচ্ছে কিশোর
অপরাধ।
কিশোর অপরাধী
প্রতিটি সমাজে আমরা দেখতে পাই,
কিছু লোক আছে যারা সমাজের এসব
আদর্শ ও মূল্যবোধকে মেনে চলে এবং
কিছু লোক আছে যারা সেগুলোকে
লঙ্ঘন করে। এসব ব্যক্তিবর্গ সমাজের
শান্তি ও ঐক্যকে ব্যাহত করে এবং
এদের বলা হয় অপরাধী। যখন অল্পবয়সী
শিশু কিশোররা এসব সামাজিক
আদর্শকে লঙ্ঘন করে এবং অপরাধীর মতো
আচরণ করে তখন তাদের কিশোর
আদালতের অধীনে বিচার করা হয়। এসব
শিশু কিশোরদের বলা হয় কিশোর
অপরাধী।
অপরাধের লক্ষণ
অপরাধী শিশুরা বিপথগামী এবং
তারা বিশৃঙ্খল ও সমাজ বিরোধী আচরণ
করে থাকে। সে কারণে স্বাভাবিক
শিশুদের থেকে এসব বিপথগামী
শিশুদের আচরণ ভিন্ন প্রকৃতির হয়ে
থাকে। যেহেতু তারা সমাজ বিরোধী
আচরণের সাথে জড়িত সে কারণে
তাদের মাঝে ধ্বংসাত্মক মেজাজ
এবং আক্রমণাত্মক আচরণ দেখা যায়।
তাদের অপরাধমূলক কিছু লক্ষণ নিম্নরূপ-
(ক) এসব শিশুদের মাঝে সমাজবিরোধী
চিন্তা লক্ষ্য করা যায় এবং তারা
ব্যাপকভাবে ধ্বংসাত্মক
ক্রিয়াকলাপের সাথে জড়িত থাকে;
(খ) মেজাজের দিক দিয়ে এরা
আক্রমণাত্মক এবং উচ্ছৃঙ্খল প্রক্রিতির
হয়ে থাকে;
(গ) শারীরিকভাবে এরা শক্তিশালী
হয়ে থাকে এবং এদের মাঝে দৃঢ়
সংকল্প , সাহসী মনোভাব এবং আচরণ
লক্ষ্য করা যায়;
(ঘ) তারা পরিবার এবং বিদ্যালয়
কর্তৃপক্ষের প্রতি অসহযোগিতামূলক এবং
অনমনীয় হয়ে থাকে। তাদের মধ্যে নতুন
কোন কার্যক্রম সম্পর্কে কর্তৃপক্ষকে প্রশ্ন
এবং বিরোধিতা করার প্রবণতা দেখা
যায়।
(ঙ) তাদের মধ্যে বিষণ্ণতামূলক এবং
অস্থির আবেগিয় ব্যক্তিত্তের লক্ষ্যন
দেখা যায়।
কিশোর অপরাধের কারণঃ-
কিশোর অপরাধের জন্য বহুবিধ কারণ
দায়ী। কোনো নির্দিষ্ট কারণে
অপরাধ সৃষ্টি হয় না। তবে অপরাধ
বিজ্ঞানী, সমাজ বিজ্ঞানী এবং
মনোবিজ্ঞানীগণ অপরাধ বিশ্লেষণ
করে যে প্রধান প্রধান কারণ আবিষ্কার
করেছেন তা নিম্নরূপ-
(১) জৈবিক কারণঃ
মনোবিজ্ঞানীদের মতে, মানুষের
দৈহিক গঠন এবং বৈশিষ্ট্য অপরাধ
প্রবণতার জন্য দায়ী। ত্রুটিপূর্ণ দৈহিক
গঠন, স্নায়ুতন্ত্রের ত্রুটি প্রভৃতি শিশু-
কিশোরদের মাঝে হীনমন্যতাবোধ
এবং অস্বাভাবিক আচরণের সৃষ্টি করে।
ফলে সে পরিবেশের সাথে
স্বাভাবিক উপযোগ স্থাপনে ব্যর্থ
হয়ে অপরাধ প্রবণ হয়ে ওঠে
(২) বংশগত কারণঃ বংশের কেও
অপরাধী হয়ে থাকলে তাঁর পরবর্তী
প্রজন্ম অপরাধী হতে পারে। এটা জিন
দ্বারা বাহিত হয়। তবে এর পক্ষে
বিপক্ষে নানা মত আছে।
(৩) মনবৈজ্ঞানিক কারনঃ অপরাধ
মনোবিজ্ঞানী গডার্ড এ ধরণের অপরাধ
প্রবণতার জন্য মানসিক অক্ষমতা বা
দোষত্রুটি কে দায়ী করেছেন।
মানসিক বৈকল্য এবং অসুস্থতার সঙ্গে
অপরাধ প্রবণতা প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত।
শিশুদের অপরাধ প্রবণতার জন্য যে সকল
মানসিক কারণ দায়ী তা নিম্নরূপঃ
(ক) প্রত্যাখাত শিশু
(খ) অতিরিক্ত আদর ও স্নেহ
(গ) অতিশাসন
(ঘ) পারিবারিক ও দাম্পত্য কলহ
(ঙ) অসামঞ্জস্য পূর্ণ আচরণ
(চ) পিতা-মাতার অতি উচ্চাশা
(ছ) নিরাপত্তা বোধের অভাব
(৪) পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক কারণঃ
পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক কারণকে
নিম্নোক্ত ভাগে ভাগ করা যায়।
(ক) দারিদ্র্য
(খ) বিপর্যস্ত গৃহ
(গ) বহিঃজগতের পরিবেশ
(ঘ) অস্বাস্থ্যকর বিদ্যালয় প্রথা
(৫) সামাজিক কারণঃ শিশুকিশোরদের
অপরাধ প্রবণতা সামাজিক
কুসংস্কারের জন্য অনেকটা দায়ী ।
সামাজিক কারণের আওতায় যে সকল
অপরাধ প্রবণতা দেখা যায় তা নিম্নরূপ-
(ক) পারিবারিক ভাঙ্গন,বিচ্ছেদ,
বিবাহ বিচ্ছেদ
(খ) দাম্পত্য কলহ
(গ) সামাজিকীকরণের অভাব
(ঘ) চিত্তবিনোদনের অভাব
(ঙ) বিদেশি চিত্তবিনোদন ও
সংস্কৃতির অভাব
(চ) ত্রুটিপূর্ণ সামাজিক পরিবেশ
কিশোর অপরাধ আইনঃ
পৃথিবীর অনেক দেশের মতোই
বাংলাদেশেও শিশু অপরাধীদের
বিচার ও সংশোধনের জন্য পৃথক আইন,
আদালত এবং সংশোধনআগার রয়েছে।
২০১৩ সালের শিশু আইনটি কার্যকর আইন।
এটি শিশুদের অধিকার ও বিচারের
ক্ষেত্রে একটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন
আইন। এই আইনে প্রাপ্তবয়স্ক অপরাধীদের
সাথে একই আদালতে বা কার্যক্রমের
মতো শিশুদের বিচার না করার বিধান
রয়েছে। আইনে শিশু অপরাধীদের
বিচারের চেয়ে তাদের সংশোধনের
বিষয়টি বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
বর্তমানে আমাদের দেশে ৩ টি
কিশোর আদালত রয়েছে। এগুলো টঙ্গি,
যশোর এবং কোনাবাড়িতে অবস্থিত।
সরকারি গ্যাজেট প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী
টঙ্গি আদালতের অধীনে আছে ঢাকা
চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগ। এবং
যশোরের মধ্যে আছে খুলনা,রাজশাহী ও
বরিশাল বিভাগ। অন্যদিকে
কোনাবাড়িতে শুধু মেয়ে শিশুদের
আদালত ও সংশধনাগার অবস
এই আইনের অধীনে শিশুদের হাতকড়া
পরানো বা কোমরে বেড়ি বা রশি
ইত্যাদি পরানো নিষেধ।
একটি শিশু কোন অপরাধে গ্রেপ্তার
হলে বিষয়টি পুলিশ প্রথমে প্রবেশন
কর্মকর্তাকে জানাবেন। এর মাধ্যমে
প্রথমে শিশুকে একজন প্রবেশন কর্মকর্তার
কাছে হস্তান্তরের মাধ্যমে তাকে মূলত
সংশোধনমূলক প্রক্রিয়ায় হস্তান্তর করা
হয়। প্রবেশন কর্মকর্তার তদন্ত
প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই আদালত
পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে।
শিশু আইন ২০১৩ এর ধারা-৪ অনুযায়ী,
বিদ্যমান অন্য কোন আইনে ভিন্নতর
যাহা কিছুই থাকুক না কেন, এই আইনের
উদ্দেশ্যপূরণকল্পে, অনুর্ধ্ব ১৮ (আঠার) বৎসর
বয়স পর্যন্ত সকল ব্যক্তি শিশু হিসাবে গণ্য
হইব
শিশু আইন ২০১৩ এর ধারা ২(৩) অনুযায়ী
‘আইনের সহিত সংঘাতে জড়িত শিশ
(Children in Conflict with the Law)’ অর্থ এমন
কোন শিশু যে, দণ্ডবিধির ধারা ৮২ ও ৮৩
এ বিধান সাপেক্ষে, বিদ্যমান কোন
আইনের অধীন কোন অপরাধের দায়ে
অভিযুক্ত অথবা বিচারে দোষী
সাব্যস্ত;
আইনের ১৭ ধারায় বলা আছে, যে সকল
দালান বা কামরায় প্রচলিত
আদালতের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়
তাছাড়া যতদূর সম্ভব অন্য কোন দালান
বা কামরায় প্রচলিত আদালতের মতো
কাঠগড়া ও লালসালু ঘেরা
আদালতকক্ষের পরিবর্তে একটি সাধারণ
কক্ষে শিশু আদালতের অধিবেশন বসবে।
আমাদের করণীয়/অপরাধ প্রবণতা দূর
করার উপায়ঃ
অপরাধ প্রবণতা যদিও একটি বয়সের ধর্ম,
তবুও কোনো মানুষ এই অপরাধকে
সুনজরে দেখে না। তাই যতটা সম্ভব
ছেলেমেয়েদের মধ্যে যাতে এ
প্রবণতা সৃষ্টি না হতে পারে তার জন্য
আমাদের আগে থেকেই সতর্ক থাকা
উচিত। অপরাধ প্রবণতা দূর করার জন্য
দু'ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে
পারে। যেমনঃ
(ক) প্রতিরোধমূলক
(খ) প্রতিকার বা সংশোধন মূলক ব্যবস্থা
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাঃ
অপরাধ প্রবণতা দূর করার জন্য
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাগুলো নিম্নরূপ
১। পিতা-মাতাকে সন্তান লালন
পালনের জন্য সুশিক্ষা অর্জন করতে হবে
২। শিশুদের খারাপ সঙ্গ ও অসামাজিক
লোকদের থেকে দূরে রাখা
৩। বিদ্যালয়ের শিক্ষা ও পরিবেশের
মান উন্নয়ন করা
৪। গৃহের পরিবেশ উন্নত করা
৫। শিক্ষার্থীদের মৌলিক চাহিদার
জোগান দেয়া
৬। শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত শিক্ষার
ব্যাবস্থা করা
৭। নৈতিক আদর্শের বিকাশ ঘটানো
৮। সহপাঠ্য ক্রমিক কার্যাবলীর ব্যবস্থা
করা
৯। সামাজিক রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা দূর
করা
১০। রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা অ ন্যায়নীতির
সঠিক প্রয়োগ করা
১১। জীবনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ
পাঠ্যবিষয় শিক্ষাক্রমে অন্তর্ভুক্ত করে
১২। জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের যথার্থ
পদক্ষেপ গ্রহণ করে
১৩। সুন্দর বিনোদনের ব্যবস্থা করে
প্রতিকারমূলক বা সংশোধন মূলক
ব্যবস্থাঃ
যে সকল শিশু ও কিশোর ইতোমধ্যে
নানাবিধ অপরাধের সাথে জড়িত হয়ে
পরেছে তাদের সংশোধনের জন্য
নিম্নলিখিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা একান্ত
প্রয়োজন-
১। শারীরিক ও মানসিক শান্তির
ব্যবস্থা করে
২। সামাজিকভাবে একঘরে না করে
৩। অপ ও কুসংস্কৃতি দূর করে
৪। মনবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা প্রয়োগ
করে
৫। কিশোর অপরাধ কোর্টের মাধ্যমে
বিচারের ব্যবস্থা করে
৬।সংশোধন ও পুনর্বাসনের জন্য বিশেষ
বিদ্যালয়ে বিশেষ শিক্ষার ব্যবস্থা
করে
৭। কিশোর অপরাধীদের বিভিন্ন
ব্যক্তি বা সংস্থার হাতে দায়িত্ব
ন্যস্ত করে
৮। প্রয়োজনে জেল জরিমানা ও অন্য
শাস্তির ব্যবস্থা করে
উপরের বর্ণিত অবস্থা বিবেচনা করে
আমরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি
যে, শিশুকে যোগ্য মানুষ হিসেবে গড়ে
তুলতে হলে বাল্যকাল থেকে ধর্মীয়
বিধিবিধান এবং অনুশাসনের মাধ্যমে
তাদের গঠন করে তুলতে হবে। ধর্মীয়
অনুশাসন প্রত্যকটি মানুষকে শৃঙ্খলার
মধ্যে আবদ্ধ রাখে। যা শিশু এবং
কিশোরদের জন্য খুবই উপকারী।
অভিভাবক হিসেবে আমাদের মনে
রাখতে হবে ধর্মহীন শিক্ষা মূল্যহীন।
শিশু এবং কিশোররা যে শিক্ষা
লাভ করবে তার মধ্যে ধর্মীয় প্রতিফলন
থাকলে তারা বিপদগামী পথে না
গিয়ে শৃঙ্খলার মধ্যে আসবে। তাই
অভিভাবক হিসেবে আমাদের ধর্মীয়
দিকটি বিবেচনা করে তাদের মানুষ
হিসেবে গঠন করে তোলা উচিত।
শিশুরা দেশ ও জাতির আগামী দিনের
দর্পণ। আলোক বর্তিকা। তাদের ওপর
নির্ভর করে আছে আগামী দিনের
ভবিষ্যৎ। তাই তাদের সঠিক যত্ন ও
পরিচর্যা করে আমাদের তৈরি করতে
হবে। শিশুরা যেন নিজেদের বিকশিত
করার সব রকম সুযোগ পায় সে ব্যবস্থা
নিশ্চিত করতে হবে। তার মৌলিক
চাহিদা মিটানোসহ জীবন গড়ার জন্য
সুপরামর্শ ও সঠিক পথ নির্দেশ করতে হবে,
তাহলেই একটি শিশু অপরাধী না হয়ে
সমাজের একজন সুস্থ সরল মানুষ হিসেবে
গড়ে উঠতে পারবে।
Comments
Post a Comment