ট্রেডমার্ক/ ব্যবসার সুনাম সুরক্ষিত রাখবেন কীভাবে?

ট্রেডমার্ক/ ব্যবসার সুনাম সুরক্ষিত রাখবেন কীভাবে?

ট্রেডমার্ক আইন
ট্রেডমার্ক আইন
কুমিল্লা যাওয়ার পথে মহাসড়কের দুপাশে ‘মাতৃভাণ্ডার’ নামের অসংখ্য রসমালাইয়ের দোকান দেখতে পারবেন। এসব দোকানের সাইনবোর্ডে মূল নামটির আগে ‘আদি ও আসল’, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার স্বীকৃত’ কিংবা ‘কুমিল্লার বিখ্যাত’ ইত্যাদি সব বিশেষণ যুক্ত হলেও ‘মাতৃভাণ্ডার’ নামটি সবাই ব্যবহার করছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ব্যবহার করে যারা কুমিল্লা বা কুমিল্লার পরের জেলাগুলোতে ভ্রমণ করেন, যাত্রাপথে সবাই কুমিল্লার মাতৃভাণ্ডারের রসমালাইয়ের স্বাদ চেখে দেখতে চান এবং পরিবারের জন্য নিয়ে আসেন। এতসব মাতৃভাণ্ডারের ভিড়ে আসল মাতৃভাণ্ডার দোকানটি চাপা পড়ে যায় এবং মাতৃভাণ্ডারের সুনাম বিক্রি করে শত শত অসাধু ব্যবসায়ী গ্রাহকদের প্রতারিত করে।
আইনের ভাষায় ‘মাতৃভাণ্ডার’ এই নামটি ট্রেডমার্ক। যে নাম বা প্রতীকের মধ্য দিয়ে গ্রাহক কোনো বিশেষ উৎসের পণ্যকে সহজেই পৃথক করতে পারে এবং যে নাম বা প্রতীকের মধ্য দিয়ে কোনো ব্যবসায়ী তার পণ্যটিকে অন্য প্রতিযোগী পণ্য থেকে আলাদা রাখতে পারেন, আইনে তাকেই ‘ট্রেডমার্ক’ বলা হয়। ‘মাতৃভাণ্ডার’ নামটি দেখলেই ভোক্তার মনে বিশেষ গুণসম্পন্ন এক মিষ্টান্নের কল্পনা তৈরি হয় বলে ‘মাতৃভাণ্ডার’ নামটি ট্রেডমার্ক।
একজনের ট্রেডমার্ক অন্যজন অনুমোদনহীনভাবে ব্যবহার করলে মূল ব্যবসায়ী চরম আর্থিক লোকসানের সম্মুখীন হন। এভাবে অপরের ট্রেডমার্ক ব্যবহার করা আইনের চোখে অপরাধও বটে। ট্রেডমার্ক এক ধরনের মেধাস্বত্ব, যার অপব্যবহার ঘটলে এর মালিক আইনের আশ্রয় নিয়ে লঙ্ঘনকারীকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারেন।
এখন সমস্যা হলো, একজন ব্যবসায়ী কীভাবে প্রমাণ করবেন যে এই ট্রেডমার্কটির মালিক তিনিই? সাধারণত দুইভাবে একটি ট্রেডমার্ক নিজের অনুকূলে সুরক্ষিত রাখা যায়। প্রথমত ট্রেডমার্কটি সংশ্লিষ্ট দেশে নিজের নামে নিবন্ধন করার মাধ্যমে, দ্বিতীয়ত ট্রেডমার্কটি নিয়মিত ব্যবহারের মাধ্যমে। একটি ট্রেডমার্ক দীর্ঘদিন ধরে একজন ব্যবসায়ী যদি নিবন্ধন করা ছাড়াই ব্যবহার করে আসেন, সেক্ষেত্রে অপর একজন ব্যবসায়ী তার ট্রেডমার্কটি পরবর্তী সময়ে নিজের নামে নিবন্ধন করলেও ওই ট্রেডমার্কটির আইনগত মালিকে পরিণত হতে পারবেন না। প্রথম ব্যবহারকারী যদি তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা ঠুকে দেন এবং প্রমাণ করতে পারেন যে ট্রেডমার্কটি প্রথম তিনিই ব্যবহার করে আসছেন, তাহলে প্রথম ব্যবহারকারীর অনুকূলেই আদালত রায় দেবে। সুতরাং, ট্রেডমার্ক প্রমাণে নিবন্ধনের চাইতে ব্যবহারের গুরুত্ব অনেক বেশি।
আমাদের দেশে মেধাস্বত্ব আইনের প্রচলন খুব একটা না থাকার কারণে অনেক ব্যবসায়ীই তাদের ট্রেডমার্কের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে আইনগত লড়াই করার কথা চিন্তা করেন না। অথচ আইনের শরণাপন্ন হয়ে গুরুত্বপূর্ণ ট্রেডমার্কটিকে অপব্যবহার থেকে সুরক্ষিত রাখা যায়। বাংলাদেশে ট্রেডমার্ক সংক্রান্ত যে আইনটি প্রচলিত রয়েছে তার নাম ‘ট্রেডমার্ক আইন, ২০০৯’। এই আইনে সুনির্দিষ্টভাবে ট্রেডমার্কের সংজ্ঞা, ট্রেডমার্কের লঙ্ঘন ও তার প্রতিকার পাওয়ার উপায় বাতলে দেয়া হয়েছে।
প্যাটেন্ট, ডিজাইন এবং ট্রেডমার্ক অধিদপ্তরের ‘ট্রেডমার্ক নিবন্ধন শাখা’য় কোনো ব্যবসায়ী তার ট্রেডমার্কটির নিবন্ধন নিতে পারেন। এভাবে নিবন্ধন করার পর যদি ওই ট্রেডমার্কটি অন্য কোনো ব্যবসায়ী অনুমোদনহীনভাবে ব্যবহার করে, সেক্ষেত্রে ট্রেডমার্কটির মালিক লঙ্ঘনকারীর বিরুদ্ধে দেওয়ানি ও ফৌজদারি দুধরনের আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে। পূর্বে নিবন্ধিত কোনো ট্রেডমার্কের সঙ্গে যদি আবেদনকারীর ট্রেডমার্কের মিল থাকে, যা গ্রাহককে প্রতারিত করতে পারে, সেক্ষেত্রে পরবর্তী আবেদনকারীর ট্রেডমার্কের নিবন্ধন দেয়া হবে না। যেমন ‘বাটা’ নামটি নিবন্ধিত থাকার পর ‘রাটা’ নামে অন্য কেউ ট্রেডমার্কের নিবন্ধন পাবে না, যেহেতু ‘রাটা’ নামটি গ্রাহকদের প্রতারিত করতে পারে। শুরুতে ৭ বছরের জন্য ট্রেডমার্কের নিবন্ধন দেয়া হয় এবং এই মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে পুনরায় ১০ বছর করে সময়ের জন্য ট্রেডমার্কটি নবায়ন করা যায়। মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পর এক বছরের মধ্যে নবায়ন করতে হয়।
আগেই বলা হয়েছে যে বাংলাদেশে ট্রেডমার্ক আইনের মতো মেধাস্বত্ব আইনগুলোর ব্যবহার কাঙ্ক্ষিত মানের নয়। এ কারণে বহু ব্যবসায়ীর ট্রেডমার্ক অন্য অসাধু কর্তৃক অপব্যবহারের শিকার হওয়া সত্ত্বেও তারা আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন না। প্রচুর ব্যবসায়ী তাদের ট্রেডমার্কটির নিবন্ধন পর্যন্তও করেন না।
মাতৃভাণ্ডারের প্রসঙ্গ দিয়েই যেহেতু লেখার শুরু, এ পর্যায়ে আবারো এই ঘটনাটির আলোকেই ট্রেডমার্ক আইনের বেশ কিছু বিষয় বোঝার চেষ্টা করা যাক। মাতৃভাণ্ডারের মালিক এ অবস্থায় কী করতে পারেন? এক্ষেত্রে মাতৃভাণ্ডারের মালিক তার ট্রেডমার্কটি নিবন্ধন করেছেন কি না, সেটি দেখতে হবে। তিনি যদি ট্রেডমার্কটির নিবন্ধন করে থাকেন, সেক্ষেত্রে তিনি দেওয়ানি (ডিস্ট্রিক্ট জাজ) ও ফৌজদারি (মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বা ১ম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট) উভয় আদালতে মামলা দায়ের করতে পারেন। দেওয়ানি আদালতে মামলা করলে আদালত ট্রেডমার্ক লঙ্ঘনকারীর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা, ক্ষতিগ্রস্ত ট্রেডমার্ক মালিকের অনুকূলে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণের আদেশ দিতে পারে। আর ফৌজদারি আদালতে মামলা করলে আদালত লঙ্ঘনকারীকে সর্বোচ্চ ৩ বছরের কারাদণ্ড এবং ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড দিতে পারে।
এবারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, ট্রেডমার্ক নিবন্ধিত না থাকলে কি ট্রেডমার্কের মালিক কোনো আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন? এক্ষেত্রে আইন বলছে এ ধরনের ট্রেডমার্কের মালিক যদি আদালতের শরণাপন্ন হন, সেক্ষেত্রে আদালত তার জন্যও প্রতিকারের ব্যবস্থা রেখেছে। ট্রেডমার্কের মধ্য দিয়ে মূলত একজন ব্যবসায়ীর ‘ব্যবসায়িক সুনাম’ তৈরি হয় এবং অন্য কেউ যদি তার অনুমোদন ছাড়া সেই ট্রেডমার্ক ব্যবহার করে, সেক্ষেত্রে মূল মালিকের ব্যবসায়িক সুনাম ক্ষুণ্ন হয়। এ কারণে ট্রেডমার্ক নিবন্ধিত না হলেও আদালত সংক্ষুব্ধ ওই ব্যক্তির ব্যবসায়িক সুনাম সুরক্ষার স্বার্থে তার পক্ষে প্রতিকার প্রদান করতে পারে। অনিবন্ধিত ট্রেডমার্কের লঙ্ঘনকে আইনের ভাষায় বলা হয় ‘পাসিং অফ’। আমাদের ট্রেডমার্ক আইনের ৯৭ ধারায় ‘পাসিং অফ’ এর সাজা বলা আছে। এই বিধান অনুসারে, অনিবন্ধিত ট্রেডমার্কের মালিক প্রতিকারের জন্য ডিস্ট্রিক্ট জাজের আদালতে শরণাপন্ন হতে পারেন এবং পূর্বোল্লিখিত দেওয়ানি প্রতিকারগুলো পেতে পারেন।
অনিবন্ধিত ট্রেডমার্কের লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ নেই। সুতরাং মাতৃভাণ্ডারের এই ঘটনায় দোকানটির মূল মালিক নিবন্ধন ছাড়াও তার ট্রেডমার্ক সুরক্ষার জন্য জেলা বিচারকের আদালতে যেতে পারেন এবং ট্রেডমার্ক লঙ্ঘনকারী ব্যবসায়ীদেরকে আদালত ইচ্ছে করলে ওই ট্রেডমার্ক ব্যবহার থেকে নিবৃত্ত থাকার আদেশ এবং মূল মালিকের অনুকূলে ক্ষতিপূরণ প্রদানের নির্দেশ দিতে পারে। অনিবন্ধিত ট্রেডমার্কের জন্য সুরক্ষা চাইলে বাদিকে তিনটি বিষয় আদালতের সামনে প্রমাণ করতে হবে- ১. বাদির ব্যবসায়িক সুনাম রয়েছে, ২. তার ব্যবসায়িক সুনাম বিবাদি অপব্যবহার করেছে, ৩. এই অপব্যবহারের মধ্য দিয়ে তার সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে।
ট্রেডমার্ক নিবন্ধিত থাকার পরও কখনো কখনো ট্রেডমার্কের মূল মালিক তার মার্কটির প্রতি অধিকার হারিয়ে ফেলতে পারেন। গাফলতির কারণে দীর্ঘদিন ট্রেডমার্কটি ব্যবহার না করলে এই অবস্থা তৈরি হতে পারে। শুধু তাই নয়, ট্রেডমার্কটির মালিক যদি নিজে ট্রেডমার্কটির যথার্থ ব্যবহার করতে অক্ষম হন কিংবা অন্যের দ্বারা তার ট্রেডমার্কের অপব্যবহারের ব্যাপারে নীরব দর্শকের ভূমিকা দীর্ঘদিন ধরে পালন করেন, সেক্ষেত্রে ওই ট্রেডমার্কের প্রতি তার অধিকার নষ্ট হয়ে যেতে পারে। সুতরাং আপনি যদি আপনার ট্রেডমার্ক লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকেন এবং এভাবে দীর্ঘ সময় কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই অতিবাহিত করেন, সেক্ষেত্রে নিবন্ধন থাকা সত্ত্বেও আদালত আপনার অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া থেকে বিরত থাকতে পারে, নিবন্ধন না থাকলে যে কী হবে, সেটা সহজেই অনুমেয়।

Comments

Popular posts from this blog

** 'হেবা' ও 'হেবা-বিল-এওয়াজ' কী? **

জেনে নিন ভায়োলেশন কেইস সম্পর্কে

শোন এরেস্ট (Shown Arrest) কাকে বলে ? ..শিশুদের গ্রেপ্তারে হাতকড়া পরানো যাবেনা